দেশের সবচেয়ে সুন্দর আইটি প্রতিষ্ঠান ওলিওর সদর দপ্তর চালু হলো

কাউসার আহমেদের (বাঁয়ে) সঙ্গে গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী ইয়াসির আজমাইন (মাঝে) ও মুনির হাসানছবি: সংগৃহীত

আমরা যখন পূর্বাচলগামী ৩০০ ফুট এক্সপ্রেস হাইওয়ে থেকে ডুমনি যাওয়ার রাস্তায় ঢুকেছি, ততক্ষণে সূর্য অস্তাচলে যাওয়ার সব আযোজন শেষ করেছে, গোধূলিও যায় যায়। প্রশস্ত একটা এক্সপ্রেসওয়ে থেকে দুই লেনের একটা সরু রাস্তায় ঢুকলে যে কারও মন একটু খারাপ হতে পারে। তবে আমরা যে কয়জন গাড়িতে ছিলাম, আমাদের সে রকম হয়নি। কারণ, আমরা বাংলাদেশর তারুণ্যের ইতিহাসের নতুন একটি মাইলফলক উদ্‌যাপনে যাচ্ছি। কাজেই একসময় রাস্তার কোলাহল ছাপিয়ে আমাদের সামনে আলোকিত হয়ে উঠল চারতলা একটি ভবন। দূর থেকে আলোয় রাঙা ভবনটি দেখেই মনটা ভালো হয়ে গেল।

২১ মার্চ সন্ধ্যায় দেশের একটি আইটি কোম্পানি তাদের নিজস্ব অফিসে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছে। ওলিও নামের এই প্রতিষ্ঠান কিছুদিন আগেও জুমশেপার নামে পরিচিত ছিল। শিক্ষায় টেক্সটাইল প্রকৌশলী, কিন্তু কাজে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ কাউসার আহমেদ এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। জুমশেপারের নাম প্রথম আলোর পাঠকেরা জানেন। কারণ, ২০১৬ সালে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন আমরা কাউসারের জুমশেপারকে নিয়ে প্রথম পাতায় লিড নিউজ করেছি। আমার জানামতে, বাংলাদেশের কোনো আইটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে দেশের শীর্ষ দৈনিকের এখন পর্যন্ত এটিই একমাত্র লিড নিউজ। সে সময় কাউসারের জুমশেপার বিশ্বের জুমলাভিত্তিক (আধেয় প্রকাশের একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম) প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সেরা চারে ছিল।

ওলিও সদর দপ্তরের নানা অংশ
ছবি: সংগৃহীত

রাস্তা থেকে নেমে ভবনে ঢোকার মুখে কয়েকটি বড় ছাতার নিচে বসার জায়গা। বাস্কেটবল খেলার কোর্ট ও খেলা উপভোগ করার ছোট্ট গ্যালারি। মূল দরজার ওপরে ওলিওর লোগো বড় করে লাগানো। নিরাপত্তাবেষ্টনী পার হয়ে ভেতরে ঢুকলেই রিসিপশন। রিসিপশনের সামনে প্যাঁচানো কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠার পথ। এর সামনে ছোট্ট একটি মঞ্চ। ওখানেও রয়েছে অবসর কাটানোর নানা আয়োজন। রিসিপশন পার হয়ে নিচতলায় যথাক্রমে খেলার ঘর, খাবার ঘর ও জিমনেসিয়াম। খেলার ঘরে আছে টেবিল টেনিস, ফুটবলসহ অন্য খেলার আয়োজন। কফি খাওয়ার একটি বড় জায়গা এবং তারপরই একসঙ্গে ৬০ জন বসতে পারেন, এমন খাবার ঘর। কর্মীদের জন্য অফুরন্ত চা-কফি-কোমল পানীয় এবং দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কাল আমাদের বেশির ভাগ সময় সেখানেই কেটেছে।

এর ওপরের দুটি ফ্লোরে রয়েছে ওয়ার্কস্টেশনগুলো। প্রতি ফ্লোরে ৫০টি করে ওয়ার্কস্টেশন। যেহেতু ওপেন অফিস কনসেপ্ট, তাই প্রতিটি ফ্লোরে রয়েছে আলাদা ফোনবুথ, আছে সভাকক্ষ ও একটি মূল কনফারেন্স রুম। এ ছাড়া রয়েছে ছোট ছোট কাজের ঘর, যেখানে কয়েকজন মিলে একসঙ্গে কাজ করতে পারবেন।

দোতলাতেই একটি ছোট্ট ‘আমাজনের’ রেপ্লিকা (!) বানানো হয়েছে। মানে গাছগাছালি দিয়ে একটি সুন্দর জায়গা তৈরি করা হয়েছে, যেখানে কর্মীরা শ্রান্তি দূর করতে পারবেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলাতেও কফি কর্নার আছে। আছে লার্নিং রুম, যেখানে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। আছে আলাদা ব্রেইনস্টর্মিং কক্ষ, যেখানে নতুন নতুন আইডিয়া বের করবেন ওলিওর কর্মীরা।

ওলিও সদর দপ্তরের নানা অংশ
ছবি: সংগৃহীত

তৃতীয় তলাতেই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষ। যদিও কাউসার আহমেদ জানালেন, আগের অফিসের মতো এখানেও নিজের রুমে বসার সময় হবে কম। তৃতীয় তলাতে করা হয়েছে একটি ছাদ-বারান্দা। সেখানে ক্লান্ত কর্মীরা নিজেদের চার্জ করে নিতে পারবেন কিংবা বিকেল বা সন্ধ্যায় সময় কাটাতে পারবেন। ওই ছাদের একটি অংশ বানানো হয়েছে কাচ দিয়ে। ওপর থেকে দেখা যায় নিচের দুটি ফ্লোর।

ওলিওর অফিসটা কালারফুল। তরুণেরা তো এমনটাই করবেন, কথা প্রসঙ্গে বললেন গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসির আজমান। তিনিসহ কাল দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের একদল তরুণ-তরুণী সেখানে জড়ো হয়েছেন কাউসার আহমেদের স্বপ্নপূরণের সঙ্গী হতে। সব ফ্লোরে রঙের পরিমিত কিন্তু আকর্ষণীয় ব্যবহার হয়েছে। কাউসার আহমেদ নিজেই তাঁর প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার পরিকল্পনা করেছেন।

ওলিও সদর দপ্তরের নানা অংশ
ছবি: সংগৃহীত

২০১০ সালে ভিন্ন কিছু করার ইচ্ছা থেকে টেক্সটাইল প্রকৌশলী কাউসার আহমেদ জুমলা টেমপ্লেট বানানোর কাজ শুরু করেন। আর অন্য কোনো ক্রয়–বিক্রয় ওয়েবসাইটে (মার্কেটপ্লেসে) সেটি বিক্রি না করে নিজেই জুমশেপার নামে একটা ক্রয়–বিক্রয় ওয়েবসাইট তৈরির কাজ শুরু করেন। এর পর থেকে ক্রমাগত এগিয়ে গেছেন।

তবে কাউসারের শুরুটা মোটেই সহজ ছিল না। টেক্সটাইল কলেজে (বর্তমানে বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইউনিভার্সিটি) পড়ার সময় টিউশনির টাকা জমিয়ে ২০০৬ সালে এলিফ্যান্ট রোড থেকে ৭ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে অনেক পুরোনো কম্পিউটার কেনেন কাউসার। তাতেই তাঁর প্রোগ্রামিংয়ে হাতেখড়ি। কলেজের আবাসিক হলে কোনো ইন্টারনেট নেই। কাজেই কাউসারের ভরসা বই আর সাইবার ক্যাফের ইন্টারনেট। তা দিয়েই ধীরে ধীরে দক্ষতা বাড়ানো। শুরুতে ডেস্কটপ প্রোগ্রামিং ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের কাজ করে কাউসার আসেন ওয়েবের দুনিয়ায়। আর খুঁজতে থাকেন নতুন কোনো কাজ, যা দীর্ঘদিন ধরে কাজে লাগবে। একসময় বুঝতে পারেন, ওয়েবসাইট না বানিয়ে বরং ওয়েবসাইট বানানোর কলকবজা বানানোই ভালো হবে। তারপরই শুরু জুমশেপারের। আর মাত্র এক যুগের মাথায় কাউসার আহমেদ ওলিওর নিজস্ব সদর দপ্তর তৈরি করেছেন, যেটি আমার জানামতে দেশের সবচেয়ে সুন্দর আইটি অফিস।

ওলিও সদর দপ্তরের নানা অংশ
ছবি: সংগৃহীত

নিজের পথে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি অন্যদের অনুপ্রাণিত করার জন্য কাজ করে যাবেন ৩৮ বছর বয়সী এই উদ্যোক্তা। বাবা মোহাম্মদ আলী আকবর ও মা জাহেদা খাতুনের তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে কাউসার দ্বিতীয়। বাবা-মায়ের সঙ্গে চাকরিজীবী স্ত্রী জিনিয়া আখতার এবং দুই কন্যা জারা ও সারাকে নিয়ে কাউসার থাকেন ঢাকাতেই।
২০১৬ সালে তরুণ উদ্যোক্তাদের সংগঠন ‘চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব’ তাঁকে ‘নুরুল কাদের সম্মাননা ২০১৫’তে ভূষিত করে।