দেশে গণমাধ্যমকে একধরনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলতে হয়

আন্তর্জাতিক মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার বিকেলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা বিভাগ আয়োজিত ওয়েবিনারে আলোচকেরা

গণমাধ্যমকে এখন একধরনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলতে হয়। সাংবাদিকতার এতটা খারাপ অবস্থা আগে কখনো দেখা যায়নি। এ অবস্থায় ভয়ের ক্ষেত্র দূর করে বৈচিত্র্যময় স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন। ৩ মে (বুধবার) আন্তর্জাতিক মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার বিকেলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা বিভাগ আয়োজিত এক ওয়েবিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা।

ওয়েবিনারে ‘সরকার, গণমাধ্যম ও নাগরিকদের মধ্যে একটি ফলাফলভিত্তিক ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা মডেল’ উপস্থাপন করা হয়। আলোচনায় বক্তারা বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) কয়েকটি ধারার কারণে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এই আইনের মাধ্যমে সাংবাদিক নিগ্রহ চলছে। গণমাধ্যমে এখন স্ব আরোপিত নিয়ন্ত্রণ চলে। গণমাধ্যমকে সমঝোতা করে চলতে হয়। মুক্তভাবে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না। সরকারের অনুরাগভাজন অনেক ব্যক্তি মুক্ত গণমাধ্যমের দিকে নজর না দিয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠায় বিনিয়োগ করছেন।

আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল উদ্বেগ প্রকাশ করছে। সে ক্ষেত্রে সরকারের ভাবমূর্তি আর থাকে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) কয়েকটি ধারা স্পষ্ট নয়। এতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত না করে ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। এ আইনে যেসব মামলা হয়েছে, তার এক–চতুর্থাংশ হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে।

সাংবাদিকতা বিভাগের এই শিক্ষক বলেন, একটি দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান সংবাদমাধ্যম নিরাপত্তাহীন থাকলে সত্যিকারের অর্থে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকে না। সাংবাদিকতা এখন এতটা খারাপ অবস্থায় আছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীনের মতে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে গণমাধ্যমকে বৈচিত্র্যময় করা সম্ভব, ভয়ের ক্ষেত্রগুলোকে দূর করা সম্ভব।

আলোচনায় প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, সরকার, জনগণ ও গণমাধ্যমের মেলবন্ধন হলে কতটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে, তার উদাহরণ অ্যাসিড–সহিংসতা ও মঙ্গা কমে যাওয়া। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বিখ্যাত মন্তব্য ‘সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকলে দুর্ভিক্ষ হবে না’ তুলে ধরে আনিসুল হক বলেন, ‘কিন্তু দেখা গেছে, সংবাদ প্রকাশের কারণে প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান ও রোজিনা ইসলামকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। তবে আশার কথা হলো, সংবাদমাধ্যম যদি বস্তুনিষ্ঠ খবর প্রকাশ করে, তাহলে তাতে কাজ হয়। কর্তৃপক্ষ সাড়া দেন এবং তাতে ফল আসে।’

বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য তুলে ধরে আব্দুন নূর তুষার বলেন, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত তিন মাসে ৫৬ জন সাংবাদিক নিগ্রহের শিকার হয়েছে। তিনি বলেন, দেশে গণমাধ্যমকে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবের মধ্যে চলতে হয়। অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে গণমাধ্যমকে সমঝোতা করে চলতে হয়।

মালিকের স্বার্থ রক্ষায় অনেক গণমাধ্যম তৈরি হচ্ছে উল্লেখ করে টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব আব্দুন নূর তুষার বলেন, একটি গণমাধ্যম তৈরির ক্ষেত্রে সব ধরনের পূর্বানুমতি নেওয়া তুলে দেওয়া উচিত। যে গণমাধ্যম সত্যিকারভাবে মানুষের কাছে পৌঁছাবে, সেটি টিকে থাকবে।

দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রতিনিধি (কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ) কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ বলেন, বাংলাদেশে সাংবাদিকতা এখন একটা চাপের মধ্যে রয়েছে। খুব খারাপ পরিস্থিতির মধ্যেও সাংবাদিকতা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ভালো সাংবাদিকতায় দক্ষতা গড়ে তুলতে উদ্যোগ নিতে হবে। নাগরিকদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে। তাদের ভালো গণমাধ্যম বেছে নিতে হবে।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সামিখশা কৈরালা বলেন, মুক্ত গণমাধ্যমের অধিকার নিশ্চিতে সরকার, জনগণ ও গণমাধ্যম—এসব অংশীদারকে সম্মিলিতভাবে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে আজকের পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক গোলাম রহমান গণমাধ্যমকেও দায়িত্বশীল আচরণ করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, দায়িত্বশীল আচরণ করতে হলে গণমাধ্যমকেও কিছু বিষয় মেনে চলতে হবে। পেশাগত নৈতিকতা তুলে ধরতে হবে। উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ভুল করা হলে, সম্পাদনার সময় নিজের বক্তব্য প্রচার করলে দায় অস্বীকার করার উপায় নেই। ডিএসএ নিয়ে তাঁর মত হচ্ছে, প্রযুক্তির এ সময়ে কারও আইনি সহায়তা লাগবে, তাদের জন্য আইনটির প্রয়োজন রয়েছে। তবে আইনে কিছু ধারা অন্যায়ভাবে যুক্ত করা হয়েছে। বিচার শুরুর আগেই কারাভোগ শুরু হয়। এটা কাম্য নয়।

আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক রিজওয়ান–উল–আলম। সভাটি সঞ্চালনা করেন একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. তৌফিক ই এলাহী।  

মূল প্রবন্ধে গণমাধ্যমের কার্যকরভাবে পরিচালিত হওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ভূমিকা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। সরকারের প্রতি আইন ও বিধির মাধ্যমে অযৌক্তিক চাপ প্রয়োগ না করে গণমাধ্যমকে জনস্বার্থ হিসেবে বিবেচনা করার আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি গণমাধ্যমের গুণগত মান হ্রাস এবং বিশেষ মহলকে সন্তুষ্ট রাখার ক্ষতিকর প্রবণতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

মূল প্রবন্ধে পাঁচ দফা সুপারিশ করে একটি মডেল উপস্থাপন করা হয়। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে—গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে অন্য সব মানবাধিকারের ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় যোগাযোগ কৌশল প্রণয়ন, কমিউনিটি রেডিওকে স্থানীয় সংবাদ সম্প্রচারে উৎসাহিত করা, জনসাধারণের মধ্যে গণমাধ্যমসংক্রান্ত জ্ঞান বাড়ানো, সংবাদ ন্যায়পালের ভূমিকা সম্প্রসারণ এবং গণমাধ্যমের টেকসই সাংবাদিকতার নীতি মেনে চলা।