নিউমোনিয়া ভালো না হতেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত তিন মাসের কাশিফ

হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরে যাবে, এমন সময় কাশিফ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। পাঁচ দিন ধরে কাশিফ ডেঙ্গুজ্বরে ভুগছে
ছবি: সৌরভ দাশ

মাত্র তিন মাস বয়সী কাশিফ আল কবিরকে নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ করছেন বাবা মো. হুমায়ূন কবির ও মা জান্নাতুল ফেরদৌস। নিউমোনিয়া নিয়ে শিশুটি হাসপাতালে আসে। চিকিৎসায় অবস্থা ভালোর দিকে যেতেই নতুন বিপদ আসে। হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরে যাবে, এমন সময় কাশিফ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। পাঁচ দিন ধরে কাশিফ ডেঙ্গুজ্বরে ভুগছে।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদে অবস্থিত মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগে ছেলেকে কোলে নিয়ে ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টায় অনেকটা হাঁপিয়ে ওঠেন মা জান্নাতুল ফেরদৌস। পাশে দাঁড়ানো হুমায়ূন কবিরের চোখেমুখে তখন উদ্বেগ।

ছেলের অবস্থা জানতে চাইলে অনেকটা ক্লান্ত স্বরে হুমায়ূন কবির বলেন, ‘ছেলেটার জ্বর কমছে না। জোর করেও কিছু খাওয়াতে পারছি না। রক্তের অণুচক্রিকা (প্লাটিলেট) ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার। সেখান থেকে কমে ২ লাখ ৫০ হাজারে নেমে আসে। এরপর একধাক্কায় নেমে আসে এক লাখে। কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না।’

কক্সবাজারের চকরিয়ার পূর্ব বড় ভেউলা এলাকার বাসিন্দা হুমায়ূন ও জান্নাতুল ফেরদৌস। হুমায়ূন চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেন। এই দম্পতির প্রথম সন্তান কাশিফ। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর ৫ সেপ্টেম্বর কাশিফকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি করানো হয়। সেখান থেকে ৭ সেপ্টেম্বর তাকে আনা হয় মা ও শিশু হাসপাতালে। এ হাসপাতালেই চলছিল নিউমোনিয়ার চিকিৎসা। চিকিৎসকেরা হুমায়ূন কবিরকে বলেছিলেন, কাশিফের অবস্থা ভালোর দিকে।

নগরের টাইগারপাস এলাকা থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৫ দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে মিনহাজ উদ্দীন। উৎকণ্ঠায় ছেলের শয্যার পাশে দিন কাটছে বাবা জামাল উদ্দীনের। বিকেল ৪টায় চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে। ১৪ সেপ্টেম্বর
ছবি: সৌরভ দাশ

হুমায়ূন কবির প্রথম আলোকে বলেন, ৯ সেপ্টেম্বর হঠাৎ জ্বর ওঠে কাশিফের। সেদিনই পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে। ছেলেটাকে নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা হচ্ছে। প্রথমে নিউমোনিয়া, এরপর ডেঙ্গু; এ দুই রোগের ধকলে ছেলেটা কাহিল হয়ে পড়েছে।

জান্নাতুল ফেরদৌসের চোখেমুখেও যেন ভয়ের ছাপ লেগে ছিল। গত ৯ জুন তিনি মা হয়েছেন। ছেলেকে নিয়ে অনেকটা নির্ঘুম রাত কাটাতে হচ্ছে তাঁকে। জান্নাতুল বলেন, অনেক কষ্ট করে খাওয়াতে হচ্ছে। ছেলেটা দুর্বল হয়ে গেছে।

হাসপাতালে শুধু কাশিফ নয়, তার মতো আরও ২৫ শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। নগরের মিরসরাই থেকে ১২ বছর বয়সী পূর্ণ বড়ুয়াকে নিয়ে এসেছেন মা সুমি বড়ুয়া। গত মঙ্গলবার পূর্ণকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সে-ও ডেঙ্গুজ্বরে কাহিল। চলছে স্যালাইন। সুমি বড়ুয়া বলেন, চটপটে মেয়েটা হঠাৎ করে দুর্বল হয়ে গেল।

আরেক শিশু মোহাম্মদ তামিমের বয়স ১৩ মাস চলছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর গতকাল বুধবার তাকে হাসপাতালে আনেন বাবা মোহরম আলী।

হাসপাতালটির পরিচালক মো. নুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত সব রোগীকে বিশেষ করে শিশুদের বেশি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। চিকিৎসকেরা নিয়মিত দেখছেন। পরামর্শ দিচ্ছেন।

চার বছরে এবারই বেশি রোগী, বেশি মৃত্যু

চট্টগ্রাম জেলায় গত চার বছরে এবারই সবচেয়ে বেশি রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মৃত্যুও হয়েছে বেশি। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন মাত্র ১৭ জন। ওই বছর কোনো রোগীর মৃত্যু হয়নি। পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে রোগী বেড়ে যায় ১৬ গুণ, ভর্তি হন ২৭২ জন। মারা গেছেন পাঁচজন।

গত বছর হাসপাতালে ভর্তি হন ৫ হাজার ৪৪৫ জন, মৃত্যু হয় ৪১ জনের। আর চলতি বছরের শুরু থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত ৭ হাজার ৪৫১ রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে ৬৩ জনের। শেষ ২৪ ঘণ্টায় (গতকাল সকাল আটটা থেকে আজ সকাল আটটা পর্যন্ত) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১০০ রোগী।

৫ বছর বয়সী শিশু আবরারকে দেখভালে ব্যস্ত সময় পার করছেন তার মা। চট্টগ্রাম নগরের রোঙ্গী পাড়া এলাকা থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে শিশুটি হাসপাতালে ভর্তি হয় বুধবার। চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে। ১৪ সেপ্টেম্বর
ছবি: প্রথম আলো

সীতাকুণ্ডে সবচেয়ে বেশি রোগী

চলতি বছর চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলা থেকে সবচেয়ে বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চট্টগ্রামে উপজেলা রয়েছে ১৫টি। এর মধ্যে লোহাগাড়ায় ডেঙ্গু রোগী ৭৮, সাতকানিয়ায় ১০৪, বাঁশখালীতে ১৫৭, আনোয়ারায় ১০৪, চন্দনাইশে ৪৪, পটিয়ায় ২৩৩, বোয়ালখালীতে ৫৬, রাঙ্গুনিয়ায় ৪৬, রাউজানে ৮০, ফটিকছড়িতে ১১৬, হাটহাজারীতে ১৭৮, মিরসরাইয়ে ১৪৬, সন্দ্বীপে ৫২, কর্ণফুলীতে ৫৫ এবং সীতাকুণ্ডে ৮৭৬ রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুই চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, সীতাকুণ্ডে এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি নাজুক। রোগীদের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা জেনেছেন, সীতাকুণ্ডে মশা মারার ওষুধ ঠিকঠাক ছিটানো হয় না।

ডেঙ্গু বাড়ার বিষয়ে সীতাকুণ্ড উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, মশা মারতে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। কিন্তু প্রতিটি গ্রামে গিয়ে ওষুধ ছিটানো সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও চেষ্টা চালানো হচ্ছে। মানুষকে সচেতন করতে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।