আধেয় সরিয়ে নেওয়া
সরকারের অনুরোধ বাড়ছে, গুগলের সাড়া কম
সরকার গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে ৮৬৭টি আধেয় সরিয়ে নিতে অনুরোধ করে। এর ৫৭ শতাংশ আধেয় ছিল সরকারের সমালোচনামূলক।
বাংলাদেশ সরকার গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে গুগলের কাছে আধেয় বা কনটেন্ট সরিয়ে নিতে ৮৬৭টি অনুরোধ করেছে। তবে প্রায় ৭৬ শতাংশ ক্ষেত্রে গুগল কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, অর্থাৎ আধেয় সরিয়ে নেওয়া হয়নি। যেসব আধেয় সরিয়ে নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছিল, তার ৫৭ শতাংশ ছিল সরকারের সমালোচনামূলক।
গুগল নিয়মিত তাদের স্বচ্ছতা প্রতিবেদনে আধেয় সরানো ও ব্যবহারকারীর তথ্য চাওয়ার হিসাব প্রকাশ করে। এতে সরকার কী ধরনের আধেয় সরিয়ে নেওয়ার আবেদন করে এবং তারা কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তার চিত্র তুলে তুলে ধরা হয়।
গুগল বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় একটি তথ্যপ্রযুক্তি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। তাদের সেবার মধ্যে রয়েছে ভিডিও শেয়ারিং সাইট ইউটিউব। সরকারের তথ্য চাওয়া এবং আধেয় সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধের বেশির ভাগ ইউটিউবকেন্দ্রিক।
ব্যবসার খাতিরে আজ হোক কাল হোক তারা অনেক ক্ষেত্রেই আপস করবে, যা মতপ্রকাশ বা বাক্স্বাধীনতাকে সংকুচিত করতে পারে।বি এম মইনুল হোসেন, অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
স্বচ্ছতা প্রতিবেদনে গুগল জানিয়েছে, গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে সরকারের সমালোচনামূলক আধেয় সরানোর ৪৯১টি অনুরোধ পাওয়া যায়। এ ছাড়া মানহানিকর আধেয় সরিয়ে নিতে ২৭৭টি, ধর্মের অবমাননাকর আধেয় সরিয়ে নিতে ২৫টি, প্রতারণামূলক আধেয় সরিয়ে নিতে ১৫টি এবং অন্যান্য বিষয়ে আধেয় সরিয়ে নিতে ৩২টি অনুরোধ পায়। অশ্লীলতা, জাতীয় নিরাপত্তা, গোপনীয়তা, মেধাস্বত্ব বা কপিরাইটসহ বিভিন্ন কারণে সরকার গুগলের কাছে কিছু কিছু আধেয় সরানোর অনুরোধ করেছে।
সবচেয়ে বেশি অনুরোধ করা হয়েছে ইউটিউবের ভিডিও সরানোর জন্য। গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে মানহানি ও সরকারের সমালোচনার জন্য মোট ৬১৮টি ভিডিও সরানোর অনুরোধ করে বাংলাদেশ। ধর্মবিষয়ক ৩৪টি, ঘৃণা ছড়ানোর বক্তব্যবিষয়ক ২০টি এবং অনৈতিক ও অশ্লীল ১৮টি ভিডিও সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করা হয়।
গুগল ২০১১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে আধেয় সরানোর মোট অনুরোধ পায় ২ হাজার ৩৭৫টি। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে অনুরোধ ছিল ৭০৭টি। ফলে ২০২২ সালে মোট অনুরোধ দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৭৪টি। দেখা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গুগলের কাছে আধেয় সরানোর অনুরোধ ব্যাপকভাবে বাড়ছে।
কত আধেয় সরানো হলো
সরকারের অনুরোধ বলতে গুগল সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া অনুরোধের কথা বুঝিয়েছে। আগেই বলা হয়েছে যে গুগল গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে সরকারের অনুরোধের পরও ৭৬ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তারা জানিয়েছে, মোট অনুরোধের ১৬ শতাংশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট তথ্য ছিল না। গুগলের নীতি লঙ্ঘিত হওয়ায় সাড়ে ৪ শতাংশ আধেয় সরিয়ে নেওয়া হয়। আইনি কারণে তারা দেড় শতাংশের বেশি আধেয় সরিয়েছে। এ ছাড়া ১ শতাংশের বেশি আধেয় তারা সরকারের অনুরোধ পাওয়ার আগেই সরিয়ে নিয়েছিল।
গুগল বলছে, বিভিন্ন দেশের আদালত ও সরকারি সংস্থাগুলো নিয়মিত তাদের সেবা থেকে তথ্য সরানোর অনুরোধ করে। তারা এই অনুরোধগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে। যেসব অনুরোধ তাদের কাছে যায়, সেগুলো যদি নিজস্ব নীতি লঙ্ঘন করে, তাহলেই গুগল তা সরিয়ে নেয়।
বাংলাদেশের সরকারের কাছ থেকে ছয় মাসে পাওয়া দুটি অনুরোধের বিষয়ে কিছু তথ্য জানিয়েছে গুগল। সে দুটি হলো বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ৮টি অ্যাপ গুগল প্লে স্টোর থেকে এবং একটি লিংক সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করেছিল। এগুলো জুয়া ও বাজির প্রচারে ব্যবহৃত হচ্ছিল। অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে গুগল তাদের প্লে স্টোরের নীতি লঙ্ঘন করায় অ্যাপগুলো সরিয়ে নেয়। লিংকটির বিষয়ে তারা বিস্তারিত জানতে চেয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।
বিটিআরসি একটি ভিডিও চিত্রের লিংক সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করেছিল। সেটা গুগল সরায়নি। গুগল তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ওই ভিডিও চিত্রে দুজন ভুক্তভোগীর নির্যাতনের বিবরণ রয়েছে। ভিডিও চিত্রটি নিয়ে জনসাধারণের আগ্রহ ব্যাপক। এ ছাড়া এই ভিডিও সরানোর জন্য আদালতের বৈধ কোনো আদেশ ছিল না। তাই তারা সরিয়ে নেয়নি।
তথ্য চেয়ে অনুরোধ
আধেয় সরানোর অনুরোধের পাশাপাশি ব্যবহারকারীর তথ্য চেয়েও সরকার গুগলের কাছে অনুরোধ করে।
২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রথম ছয় মাসের তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এই সময়ে ব্যবহারকারীর বিষয়ে জরুরিভাবে তথ্য চেয়ে ৯টি অনুরোধ জানিয়েছে। আইনিভাবে অনুরোধ জানানো হয়েছে ১টি। এ ছাড়া ২১টি অ্যাকাউন্টের বিষয়েও তথ্য চেয়েছিল সরকার। এসব অনুরোধের বিপরীতে গুগল ৬০ শতাংশ তথ্য প্রকাশ করেছে বলে জানিয়েছে।
নীতিমালা লঙ্ঘন করায় নিয়মিতই আধেয় সরিয়ে নেয় গুগল। যেমন ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে ইউটিউবের ১ লাখ ১৫ হাজার ৯০৭টি ভিডিও সরিয়ে নেওয়া হয়। ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে ৪ লাখ ২৬ হাজার ২৩৬টি ভিডিও সরিয়ে নেয় ইউটিউব। ভিডিও সরিয়ে নেওয়ার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের ৮ নম্বরে। শীর্ষে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও ইন্দোনেশিয়া।
গুগলের কাছে সরকারের সমালোচনাসংক্রান্ত আধেয় সরানোর অনুরোধ বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক নীতি মেনে চলে। এ ছাড়া তাদের নিজেদের নির্দেশিকা রয়েছে। সেসবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হলে প্রতিষ্ঠানগুলো অনুরোধ রাখে না।
তিনি বলেন, সরকারকে আইনের ধারা এবং কোন আধেয় কেন সরানোর প্রয়োজন, সে ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ সঠিক উপায়ে অনুরোধ জানাতে হবে। তিনি আরও বলেন, গ্রাহকদের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকলেও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো দিন শেষে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। ব্যবসার খাতিরে আজ হোক কাল হোক তারা অনেক ক্ষেত্রেই আপস করবে, যা মতপ্রকাশ বা বাক্স্বাধীনতাকে সংকুচিত করতে পারে।