চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বললেন, তাঁদের নানা অ্যাজেন্ডা ছিল

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। আজ রোববার প্রক্টরসহ গুরুত্বপূর্ণ ১৮টি পদ থেকে ১৬ জন শিক্ষক পদত্যাগ করেছেন। এরপর ক্যাম্পাসে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। জ্যেষ্ঠ শিক্ষকেরা বলছেন, স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দেওয়ায় প্রশাসনের আস্থাভাজন এসব শিক্ষক সরে গেছেন।

তবে পদত্যাগকারী শিক্ষকদের কারও কারও বক্তব্য, সিন্ডিকেট নির্বাচন, শিক্ষক সমিতি নির্বাচন, ডিন নির্বাচন—সবকিছুতেই উপাচার্যের সঙ্গে কাজ করেছেন তাঁরা। এ সময় তাঁরা অন্য শিক্ষকদের নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চেয়েছেন। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতি উপাচার্য রাখতে পারেননি। এতে তাঁরা শিক্ষকদের কাছে হেয় হয়েছেন। উপাচার্যের সহযোগিতার অভাবে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন বলে তাঁরা পদত্যাগ করেছেন।

আজ একযোগে পদত্যাগ করা শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন প্রক্টর রবিউল হাসান ভূঁইয়া, সহকারী প্রক্টর এস এম জিয়াউল ইসলাম, শহীদুল ইসলাম, রামেন্দু পারিয়াল, শাহরিয়ার বুলবুল, গোলাম কুদ্দুস লাভলু। এ ছাড়া রয়েছেন ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাস্যুরেন্স সেলের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ ওমর ফারুক। আবাসিক হলের দায়িত্বেও রদবদল হয়েছে। প্রক্টর রবিউল হাসান ভূঁইয়া শহীদ আবদুর রব হলের প্রাধ্যক্ষর দায়িত্বে ছিলেন। সে পদ থেকেও পদত্যাগ করেছেন তিনি। শাহজালাল হলের আবাসিক শিক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন সহকারী প্রক্টর শাহরিয়ার বুলবুল। তিনিও এ পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।

একযোগে ১৬ শিক্ষকের পদত্যাগের ঘটনা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে আগে ঘটেছে, এমনটা কেউ জানাতে পারেননি। এ ঘটনার পর শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কিছু শিক্ষক ও কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, বিভিন্ন পর্যায়ের নিয়োগে প্রভাব খাটিয়েছেন পদত্যাগকারীরা। তাঁদের কারও কারও পছন্দের প্রার্থীও ছিলেন। কিন্তু সবাই নিয়োগ পাননি।

পদত্যাগকারীদের মধ্যে আরও আছেন এ এফ রহমান হলের আবাসিক শিক্ষক আনাবিল ইহসান; প্রীতিলতা হলের আবাসিক শিক্ষক ফারজানা আফরিন; শহীদ আবদুর রব হলের আবাসিক শিক্ষক এইচ এম আবদুল্লাহ আল মাসুদ, রমিজ আহমদ; শামসুন নাহার হলের আবাসিক শিক্ষক শাকিলা তাসমিন; দেশনেত্রী খালেদা জিয়া হলের জ্যেষ্ঠ আবাসিক শিক্ষক শাহ আলম, আবাসিক শিক্ষক নাসরিন আক্তার, উম্মে হাবিবা; আলাওল হলের জ্যেষ্ঠ আবাসিক শিক্ষক ঝুলন ধর।

উপাচার্য যা বললেন

উপাচার্য শিরীণ আখতার প্রথম আলোর কাছে পদত্যাগের নানা কারণ উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তাঁদের (পদত্যাগকারীদের) কিছু অ্যাজেন্ডা ছিল। জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের সঙ্গে তাঁদের কিছুটা মান–অভিমান রয়েছে। তাঁদের অ্যাজেন্ডাগুলো আমরা বিভিন্নভাবে পূরণ করার চেষ্টা করেছি।’

এত দিন তাঁরা প্রশাসনের ভক্ত ছিলেন। প্রশাসনের মধু খেয়ে এখন উল্টোপাল্টা কথা বলবেন, সেটা ঠিক না।
শিরীণ আখতার, উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

কী অ্যাজেন্ডা ছিল, এমন প্রশ্নে উপাচার্য বলেন, ‘তাঁদের নিজস্ব অ্যাজেন্ডা ছিল। বিশেষ করে রবিউল হাসান ভূঁইয়ার অনেকগুলো অ্যাজেন্ডা ছিল। আমি চেষ্টা করেছি। অনেক সময় পারিনি। কারণ, পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে বিপর্যয়ে ফেলে কোনো অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।’

শিরীণ আখতার বলেন, ‘তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে এগুলো করছেন, আমি শুনছিলাম। আমি মনে মনে তৈরি ছিলাম। সে জন্য ৯ মার্চ রবিউল হাসান ভূঁইয়া ও শহীদুল ইসলামকে রিজাইন দিতে বলেছিলাম। তাঁদের বলেছিলাম, আপনাদের মধ্যে যখন অন্য রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, আপনারা যখন একটু অন্য রকম করছেন, তাই আপনারা গবেষণা করেন বা অন্য কিছু করেন, আমার প্রক্টরিয়াল বডি ছেড়ে দিন। তখন রবিউল আমার কাছ থেকে সময় চাইলেন। এরপর সময় চেয়ে বাকিদের নিয়ে পদত্যাগ করেছেন।’

অধ্যাদেশ মেনে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছেন উপাচার্য ও প্রশাসনিক পদে থাকা শিক্ষকেরা। উপাচার্য নীতিনৈতিকতা মেনে বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে পারছেন না। এ কারণে প্রশাসনে তাঁর সঙ্গে যাঁরা আছেন, সবাই ব্যর্থ। এমনকি পদত্যাগকারীরাও ব্যর্থ।
অধ্যাপক আলা উদ্দিন, সহসভাপতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি

পদত্যাগকারীদের সবাইকে রবিউল হাসান ভূঁইয়া নিয়োগ দিয়েছিলেন বলে জানান উপাচার্য। তিনি বলেন, ‘যাঁরা পদত্যাগ করেছেন, সবাইকে রবিউল নিয়োগ দিয়েছেন। চারজন ছাড়া প্রক্টরিয়াল বডির পুরোটাই রবিউলই সাজিয়েছিলেন।’

রবিউল হাসান ভূঁইয়া প্রশাসনে বিভিন্ন পদে কিছু নিয়োগ দিয়েছেন জানিয়ে শিরীণ আখতার বলেন, ‘আরও কিছু নিয়োগ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি দিইনি। এ ছাড়া তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক নিয়োগের কথা বলেছিলেন। কিন্তু এতে ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাই সেটি দেওয়া যায়নি।’

পালি বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের বোর্ড বসাতে রবিউল হাসান ভূঁইয়া বাধ্য করেছেন—এমন তথ্য উল্লেখ করেন উপাচার্য। তিনি বলেন, ‘এত দিন তাঁরা প্রশাসনের ভক্ত ছিলেন। প্রশাসনের মধু খেয়ে এখন উল্টোপাল্টা কথা বলবেন, সেটা ঠিক না।’

উপাচার্য শিরীণ আখতারের দায়িত্ব নেওয়ার চার বছর পূর্ণ হচ্ছে কয়েক মাস পর। এ কারণে শিক্ষকদের একটি পক্ষ মনে করছে, নতুন কেউ উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাবেন—এমন আশঙ্কায় প্রক্টরসহ ১৬ জন পদত্যাগ করেছেন। উপাচার্য এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাকে ওপর থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচনের আগে কোনো কিছু পরিবর্তন করার চিন্তাভাবনা কারও নেই। তাঁরা যদি মনে করেন আমার শেষ, তাই নতুন কারও কাছে যেতে হবে—তাহলে সমস্যা নেই। নতুন কারও কাছে গেলেও কি তাঁরা এ বিশ্বাসঘাতকতা ভুলে যাবেন?’

বহিষ্কার হওয়ার পর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। নেতা-কর্মীদের বিভাগগুলোতে বহিষ্কারের চিঠি ঠিক সময়ে পৌঁছায়নি। এসব ঘটনায় উপাচার্য রবিউল হাসানের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন বলে দাবি করেন। তাঁর দাবি, এসব বিষয়ে প্রক্টরিয়াল বডির অবহেলা ছিল। তবে বিস্তারিত তিনি জানাতে চাননি।

রবিউল হাসানের দাবি, সব ভিত্তিহীন

উপাচার্যের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে রবিউল হাসান ভূঁইয়া বলেন, ‘এসব কথা ভিত্তিহীন। আমি আমার জায়গা থেকে প্রশাসনকে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। দায়িত্ব পালন করার কারণে আমার গবেষণার কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত ব্যস্ততাও বেড়ে গেছে। এ কারণে আমি পদত্যাগ করেছি। আর পদত্যাগ নিয়ে যেসব কথাবার্তা এসেছে—সব ভিত্তিহীন। অনেক আগে থেকেই উপাচার্যকে মৌখিকভাবে পদত্যাগ করার বিষয়টি জানিয়ে আসছিলাম।’

‘দায়’ আছে উপাচার্যেরও

একযোগে ১৬ শিক্ষকের পদত্যাগের ঘটনা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে আগে ঘটেছে—এমনটা কেউ জানাতে পারেননি। এ ঘটনার পর শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কিছু শিক্ষক ও কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, বিভিন্ন পর্যায়ের নিয়োগে প্রভাব খাটিয়েছেন পদত্যাগকারীরা। তাঁদের কারও কারও পছন্দের প্রার্থীও ছিলেন। কিন্তু সবাই নিয়োগ পাননি।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সহসভাপতি অধ্যাপক আলা উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অধ্যাদেশ মেনে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছেন উপাচার্য ও প্রশাসনিক পদে থাকা শিক্ষকেরা। উপাচার্য নীতিনৈতিকতা মেনে বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে পারছেন না। এ কারণে প্রশাসনে তাঁর সঙ্গে যাঁরা আছেন, সবাই ব্যর্থ। এমনকি পদত্যাগকারীরাও ব্যর্থ।’

অধ্যাপক আলা উদ্দিন বলেন, ‘উপাচার্যের পাশাপাশি দায় তাঁদেরও রয়েছে। দায় এড়ানোর জন্য প্রশাসনের বিভিন্ন পদের দায়িত্বে থাকা শিক্ষকেরা সরে আসছেন। সামনে আরও অনেকে হয়তো বের হয়ে যাবেন। বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশবহির্ভূত ও প্রচলিত নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে নানা কাজ করার কারণে ইতিমধ্যে শিক্ষকসমাজ উপাচার্য ও তাঁর প্রশাসনের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।’

এদিকে পদত্যাগের পেছনে দুটি কারণ আছে বলে মনে করেন শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় এখন যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে পারে না, হয়তো এ বিষয়ে পদত্যাগকারীদের বোধোদয় হয়েছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে, চাওয়া–পাওয়ার হিসাব না মেলা। তবে যে কারণেই হোক, বর্তমানে প্রশাসনে টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগ থেকে কর্মচারী নিয়োগ—নানা সময়ে নানা অভিযোগ এসেছে।’

বর্তমান উপাচার্যের মেয়াদে বিজ্ঞপ্তি ছাড়া ও বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে শিক্ষক-কর্মচারী পদে একাধিক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ৪ মার্চ বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে সাতজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, গত ৩০ জানুয়ারি বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে নিয়োগ দেওয়া হয় ছয়জনকে। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর নিয়োগ পান দুজন। একই বছর অক্টোবরে বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগে ১৩ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

এর আগে ২০২১ সালের জুনে বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পরিচালিত ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে খণ্ডকালীন ১২ শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে নিয়োগ দেওয়া হয় ১৫ জনকে। তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার পছন্দ, ছাত্রলীগের নেতা ও কয়েকজন শিক্ষকের সুপারিশে এসব নিয়োগ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছিল।