ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে প্রায়ই তরুণদের দেখা যায় সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে ভুগতে। ফলে অনেক সময় যথেষ্ট মেধা, আগ্রহ ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা ক্যারিয়ারে ভালো করতে পারেন না। তরুণদের সঠিক দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা জোগাতে প্রথম আলো ডটকম ও প্রাইম ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘পডকাস্ট শো: লিগ্যাসি উইথ এমআরএইচ’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ রিদওয়ানুল হকের সঞ্চালনায় চতুর্থ পর্বে অতিথি হিসেবে অংশ নেন গোযায়ানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী রিদওয়ান হাফিজ। আলোচনার বিষয় ছিল ‘ক্যারিয়ারে উদ্দেশ্য, স্থিতিস্থাপকতা এবং সীমারেখার পুনঃসংজ্ঞা’।
‘ক্যারিয়ারে যখন আপনার কাছে কোনো বিকল্প পরিকল্পনা থাকবে না, তখন আপনার সফল হওয়া ছাড়াও কোনো বিকল্প থাকে না।’ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তরুণদের উদ্দেশে এ পরামর্শ দেন রিদওয়ান হাফিজ। পডকাস্ট শো: লিগ্যাসি উইথ এমআরএইচের চতুর্থ পর্বে অতিথি হিসেবে তিনি এ পরামর্শ দেন। পর্বটি প্রথম আলোর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে গত শনিবার প্রচারিত হয়।
সঞ্চালক মোহাম্মদ রিদওয়ানুল হক অনুষ্ঠানের শুরুতেই জানতে চান, ছাত্রজীবনে ‘জাভা’য় ফেল করেন। পরবর্তী সময়ে বুয়েট গ্র্যাজুয়েট হয়ে ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রিতে টেকনোলজি নিয়ে কাজ করার চিন্তা কীভাবে এল?
উত্তরে রিদওয়ান হাফিজ বলেন, ‘প্রথমত, আমি মনে করি, জীবনে ব্যর্থতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারণ, ব্যর্থতা থেকেই জীবনে সবচেয়ে বেশি শেখা যায়। সেই সময়ে জাভায় ফেল করা কিংবা বুয়েটে সিজিপিএ কম থাকার কারণেই হয়তো আমি ভিন্ন কিছু করার উদ্যোগ নিই। সেখান থেকেই প্রথম অ্যানালাইজেনের যাত্রা শুরু হয়, যা থেকে অনেক কিছু শিখতে পারি। এই ব্যর্থতাগুলো থেকে যা কিছু শিখেছি, তা পরবর্তী সময়ে কাজে লেগেছে গোযায়ান প্রতিষ্ঠার সময়।’
বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘অ্যানালাইজেন’ প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে, উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের উত্তরে রিদওয়ান হাফিজ বলেন, ‘শুরুর দিকে চ্যালেঞ্জ মূলত ছিল ডিজিটাল মার্কেটিং ইন্ডাস্ট্রি তখন নতুন, এমনকি ‘‘ডিজিটাল মার্কেটিং’’ শব্দটিও আমরা তখন ব্যবহার করতাম না, ‘‘সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট’’ বলে কাজ করতাম। যখন কাউকে কার্ড দিতাম, লেখা থাকত রিদওয়ান হাফিজ, ম্যানেজিং ডিরেক্টর। কেউ আমাদের তখন সেভাবে গণ্য করত না। সবাই ভাবত, একটা বাচ্চা ছেলে ম্যানেজিং ডিরেক্টর হলে কোম্পানির কী হবে! পরবর্তী সময়ে আমাদের ভিজিটিং কার্ডে সুপারহিরোদের থিম ব্যবহার করতে শুরু করলাম, যেমন ম্যান অব স্টিল, ওয়ান্ডার ওম্যান ইত্যাদি। আর পরে এই কার্ডগুলোই কথাবার্তার সূত্রপাত তৈরি করত এবং এভাবে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করতাম।’
আপনি সব সময় নিজেকে ‘ইন্টার্ন’ হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন, এর কারণ কী? জবাবে রিদওয়ান হাফিজ বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, ইন্টার্নরা খুব ক্ষুধার্ত হয়। তাঁরা সব কাজ করতে চায়, কোনো কাজকে ‘‘না’’ বলে না। এই মানসিকতাই ক্যারিয়ারের শেষ পর্যন্ত থাকা উচিত। যে মুহূর্তে আপনি ভাববেন সব বুঝে গেছেন এবং সব পারেন, ঠিক তখনই আপনার উন্নতির পথ থেমে যায়। বারবার ধাক্কা খেতে খেতেই আসলে আমার এই মানসিকতা এসেছে। সব সময় আরও নতুন কিছু শিখতে হবে।’
ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রিতে বিভিন্ন স্ক্যামের পরে কি মানুষ গোযায়ানের ওপর আস্থা রাখতে পারছে? উপস্থাপক মোহাম্মদ রিদওয়ানুল হকের এমন প্রশ্নের উত্তরে রিদওয়ান হাফিজ বলেন, ‘ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতেও স্ক্যাম বা অনেক সমস্যা হয়েছে, তাই বলে কি আমরা ভালো ব্যাংকগুলোকে এড়িয়ে যাব? গোযায়ান একদম শুরু থেকেই সরাসরি গ্রাহকদের সঙ্গে কাজ করে গিয়েছে, মাঝে কাউকে কখনো রাখেনি এবং রাখবেও না। গোযায়ানের লক্ষ্যই ছিল গ্রাহকদের বিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে একটি ব্র্যান্ড তৈরি করা। আমাদের করপোরেট গভর্ন্যান্স অনেক শক্তিশালী, যা গ্রাহকের আস্থা ধরে রাখায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।’
একটি স্টার্টআপ কোম্পানিতে নতুন কর্মীদের এই গভর্ন্যান্সের সঙ্গে কীভাবে অভ্যস্ত করা উচিত? এ প্রসঙ্গে রিদওয়ান হাফিজ বলেন, ‘আমার পরামর্শ হলো, কখনোই গভর্ন্যান্সের ব্যাপারে আপস করা যাবে না। আমাদের দেশে অনেক অভিজ্ঞ মানুষ আছেন, তাঁদের থেকে শিখুন, পরামর্শ ও মেন্টরশিপ চান। কোম্পানি যখন বড় হবে, তখন গভর্ন্যান্স করব—এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। শুরু থেকেই এই দিকে খেয়াল রাখতে হবে।’
গোযায়ানের দেশের বাইরে সম্প্রসারণের যাত্রা সম্পর্কে রিদওয়ান হাফিজ বলেন, ‘আমরা এখন মোট চারটি দেশে কাজ করি। দেশের বাইরে সম্প্রসারণের চিন্তাটি মূলত তখনই আসে, যখন দেখি পাকিস্তানের কোম্পানিগুলো আমাদের দেশে এসে ব্যবসা করছে। তখন মনে হতে শুরু করে, তারা যদি আমাদের দেশে এসে কাজ করতে পারে, তাহলে আমরা কেন শুধু দেশের গণ্ডির মধ্যেই থাকব। এই সাহস থেকেই আমাদের দেশের বাইরে ব্যবসা সম্প্রসারণ শুরু।’
বাংলাদেশ থেকে দেশের বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের লোকাল নিয়ন্ত্রক সংস্থা যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা কেমন? উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের উত্তরে রিদওয়ান হাফিজ বলেন, ‘আমাদের কাজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক খুবই সহায়ক ছিল। তারা আমাদের অনেক সহায়তা করেছে। বেশির ভাগ স্টার্টআপকে বিদেশি ফান্ডিং নেওয়ার কারণে হেডকোয়ার্টার বাংলাদেশের বাইরে স্থাপন করতে বলা হয়। যখন আমরা বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুরে ট্রান্সফার করি, তখন অনেক সমস্যা হয়েছিল, কিন্তু সমাধান সেন্ট্রাল ব্যাংকই দিয়েছে।’
বর্তমানে স্টার্টআপের প্রতি তরুণদের আগ্রহ প্রসঙ্গে রিদওয়ান হাফিজ জানান, স্টার্টআপের প্রতি আগ্রহ কিছুটা কমেছে। এর দুটি কারণ হলো বিশ্বজুড়ে ফান্ডিং কমে যাওয়া এবং বাংলাদেশকে অনেকে এখন একটু ঝুঁকিপূর্ণ বাজার মনে করছে। এ ছাড়া আরেকটি বিষয় হলো, অধিকাংশ স্টার্টআপ কোম্পানি তাদের টার্গেট মার্কেট জানেন না। তাই স্টার্টআপগুলো একটু চাপের মুখে আছে। তবে আপনার ব্যবসা যদি লাভজনক হয় এবং ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, তাহলে এসব সমস্যা সাময়িক।
আলোচনার শেষ পর্যায়ে রিদওয়ান হাফিজ তরুণদের উদ্দেশে বলেন, ‘বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষই মধ্যবিত্ত। আমরা মধ্যবিত্তরা সব সময় নিরাপত্তার কথাই ভাবি, তাই একসঙ্গে দু-তিনটি পরিকল্পনা রাখি। কিন্তু জীবনে ঝুঁকি নিতেও শিখতে হবে।’
গোযায়ানের শুরুর অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে রিদওয়ান হাফিজ বলেন, ‘অ্যানালাইজেন থেকে বের হয়ে আসার কিছুদিন পরই শুরু হয় কোভিড মহামারি। টানা ৯ মাস কর্মীদের বেতন দিতে পারিনি, তবু কেউ হাত ছাড়েনি। এমনকি সবাইকে আগেই বলে রেখেছিলাম, হয়তো বেতন দিতে পারব না, তবু তারা পাশে ছিল। টিম আমাকে এতটাই বিশ্বাস করেছিল যে চোখ বন্ধ করে ঝুঁকি নিতে রাজি হই। জীবনে সফল হতে হলে ঝুঁকি নিতে জানতে হবে।’