চক্রের দায়ে আবার বন্ধ মালয়েশিয়া শ্রমবাজার

নতুন নিয়োগ বন্ধ। ৩১ মার্চের পর কর্মীদের ভিসার আবেদন জমা নেওয়া হবে না। মালয়েশিয়ায় প্রবেশের শেষ সময় ৩১ মে।

প্রায় চার বছর বন্ধ থাকার পর চালু হয়েছিল মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। তবে আগের মতোই পুরোনো চক্রের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় কর্মী নিয়োগ। দেশটিতে গিয়ে লাখো বাংলাদেশি কর্মী প্রতারিত হয়েছেন। চাকরি না পেয়ে মাসের পর মাস মানবেতর জীবনযাপন করছেন কর্মীরা। অপরদিকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে শ্রমবাজারের নিয়ন্ত্রক চক্রটি। এমন অবস্থায় আবার বন্ধ হচ্ছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, নতুন করে আর বিদেশি কর্মী নিয়োগের কোনো আবেদন অনুমোদন করছে না মালয়েশিয়া সরকার। যারা ইতিমধ্যে অনুমোদন নিয়েছেন, তাঁদের কর্মীদের ৩১ মার্চের মধ্যে ভিসার জন্য আবেদন জমা দিতে হবে। এরপর আর কর্মীদের ভিসার আবেদন নেবে না দেশটি। যাঁরা ইতিমধ্যে ভিসা নিয়েছেন বা নেবেন; তাদের মালয়েশিয়ায় প্রবেশের শেষ সময় আগামী ৩১ মে।

দেশে প্রথমে ২৫ এজেন্সি দায়িত্ব পেলেও পরে এটি বাড়িয়ে ১০০ এজেন্সি করা হয়। এই চক্রের সহায়তাকারী হিসেবে মালয়েশিয়াতেও বেসরকারি এজেন্সির একটি চক্র আছে।

অবশ্য সরকারের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী বলছেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে। কর্মী পাঠানোয় কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ধীরে ধীরে সব সমস্যার সমাধান করা হবে।

বাংলাদেশের ১০ রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র গড়ে দুর্নীতি করেছে, এমন অভিযোগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর দুই দেশের মধ্যে অনেক আলোচনার পর ২০২২ সালের আগস্টে আবার শ্রমবাজার খুলে দেওয়া হয়। সব এজেন্সির জন্য উন্মুক্ত রাখার আন্দোলন হলেও তা করা হয়নি শেষ পর্যন্ত। দেশে প্রথমে ২৫ এজেন্সি দায়িত্ব পেলেও পরে এটি বাড়িয়ে ১০০ এজেন্সি করা হয়। এই চক্রের সহায়তাকারী হিসেবে মালয়েশিয়াতেও বেসরকারি এজেন্সির একটি চক্র আছে।

মালয়েশিয়ায় পাঠাতে প্রতি কর্মীর জন্য দেড় লাখ টাকা দিতে হয় ১০০ এজেন্সির নামে গড়ে ওঠা চক্রকে। এরপর একই চক্রের অধীন থাকা স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে বাণিজ্য চলছে। এতে একজন কর্মী গড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়ায় গেছেন। তবে গিয়ে চাকরি পাননি অনেকেই। এতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা থেকে মালয়েশিয়া সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। এখন দেশটির সরকার বিদেশি কর্মী নিয়োগপ্রক্রিয়া ঠিক করতে চায়। তাই নতুন করে কর্মী নিয়োগ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সমস্যার একটি কারণ হলো সিন্ডিকেট (চক্র), যারা এখানে (বাংলাদেশে) ও মালয়েশিয়ায় সক্রিয়।
মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার হাজনাহ মো. হাশিম

কর্মীদের প্রতারণা ও দুর্ভোগের জন্য দুই দেশের চক্রকে দায়ী করেন ঢাকায় নিযুক্ত মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার হাজনাহ মো. হাশিম। ১২ মার্চ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বের হয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। হাইকমিশনার বলেন, সমস্যার একটি কারণ হলো সিন্ডিকেট (চক্র), যারা এখানে (বাংলাদেশে) ও মালয়েশিয়ায় সক্রিয়।

শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্যান্য দেশ থেকেও কোনো কর্মী ১ জুন থেকে আর মালয়েশিয়ায় যেতে পারবেন না। এর জন্য বাংলাদেশের চক্রকে দায়ী করছে অন্য দেশগুলো।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (কর্মসংস্থান) খায়রুল আলম বলেন, এখন অনুমোদিত কর্মীদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এরপর মালয়েশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে করণীয় ঠিক করা হবে। সিন্ডিকেটের বিষয়টিও মন্ত্রণালয়ের বিবেচনায় আছে।

মালয়েশিয়ায় কর্মী নিবন্ধিত রিক্রুটিং এজেন্সি ১ হাজার ৫২০টি। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়া যেতে একজন কর্মীর ৮০ হাজার টাকার বেশি খরচ হওয়ার কথা নয়।

বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, ১৯৯২ সাল থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত বৈধভাবে মালয়েশিয়ায় গেছেন সাড়ে ১২ লাখ বাংলাদেশি কর্মী। এর মধ্যে গত বছর গেছেন সাড়ে তিন লাখের বেশি। এর আগের বছর গেছেন ৫০ হাজার কর্মী।

শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্যান্য দেশ থেকেও কোনো কর্মী ১ জুন থেকে আর মালয়েশিয়ায় যেতে পারবেন না। এর জন্য বাংলাদেশের চক্রকে দায়ী করছে অন্য দেশগুলো।

১৮ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সদস্যরা বলছেন, সবাইকে সুযোগ দিলে প্রতিযোগিতার কারণে অভিবাসন খরচ কমে আসত। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকে এজেন্সি চূড়ান্ত করার দায়িত্ব মালয়েশিয়ার হাতে দেওয়া হয়। এতে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী অবৈধ বাণিজ্যের সুযোগ পেয়েছে। একজন কর্মীর জন্য শুধু চক্র নিয়েছে দেড় লাখ টাকা। চার লাখের বেশি কর্মী পাঠিয়ে ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি নিয়েছে এ চক্র। গত দেড় বছরেই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে ১৮ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে।

বায়রার যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, একজন কর্মী ৮০ হাজার টাকায় মালয়েশিয়ায় যাওয়ার কথা থাকলেও সাড়ে চার লাখের কমে কেউ যেতে পারেননি। আন্দোলন করেও চক্র থামানো যায়নি। এখন একই পরিণতি হলো। অনিয়মের কারণে আবার বন্ধ হলো মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার।

একই অনিয়ম, একই পরিণতি

২০১৬ সালে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের অনলাইন কাঠামোর কাজটি পায় সিনারফ্ল্যাক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ার নাগরিক দাতো সেরি আবদুল বিন আমিন নূর হলেন এ প্রতিষ্ঠানের মালিক। তাঁর সহযোগিতায় দেশের ১০টি এজেন্সি মিলে তৈরি হয় চক্র। ৩৩ হাজার ৩৭৫ টাকায় কর্মী পাঠানোর কথা থাকলেও দুই থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করেন কর্মীরা। দুই বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় এ চক্র। এবারও মালয়েশিয়া থেকে চক্র তৈরিতে সহায়তা করেছেন দাতো আমিন। দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকার পর আবারও একই চক্রের অবৈধ বাণিজ্যের শিকার হলো শ্রমবাজারটি।

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দেশটিতে দেড় থেকে দুই লাখ বাংলাদেশি কর্মী বেকার ও মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকে নিয়মিত দূতাবাসে আসছেন সহায়তা চাইতে। দেশের মানুষের দুর্ভোগ দেখে চোখে পানি আটকানো যায় না। অথচ এ ক্ষেত্রে দূতাবাসের তেমন কিছু করারও নেই। একটি গোষ্ঠীর কারণে এমন পরিণতি হলো কর্মীদের।

একজন কর্মী ৮০ হাজার টাকায় মালয়েশিয়ায় যাওয়ার কথা থাকলেও সাড়ে চার লাখের কমে কেউ যেতে পারেননি। আন্দোলন করেও চক্র থামানো যায়নি। এখন একই পরিণতি হলো। অনিয়মের কারণে আবার বন্ধ হলো মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার।
বায়রার যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম

‘মালয়েশিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশি’ নামে ফেসবুকে একটি গ্রুপ আছে কর্মীদের। সেখানে নিয়মিত নিজেদের দুর্দশার কথা জানান কর্মীরা। সাগর নামের একজন গত মঙ্গলবার লিখেছেন, ‘কোনো ভাই একটা কাজ দিতে পারবেন, খুব সমস্যার মধ্যে আছি।’ গতকাল মাসুম আহমেদ রাসেল লিখেছেন, ‘আমার এক ভাই নতুন মালয়েশিয়ায় এসেছে। চার মাস হয় কাজ পাচ্ছে না। কাজের ব্যবস্থা করে দিলে উপকার হতো।’

 শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি জানিয়ে গতকাল বুধবার বিবৃতি দিয়েছে অভিবাসী কর্মীদের নিয়ে কর্মরত ২৩টি সংগঠনের মোর্চা বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ফর মাইগ্রেন্টস (বিসিএসএম)। এতে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সি, ওই দেশের সরকার ও কোম্পানিগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

পরিস্থিতির ভয়াবহতার কারণে মালয়েশিয়ান সরকার জুন থেকে বিদেশি কর্মী নেওয়া বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশি কর্মীদের চাকরি হারানো, বেতন না পাওয়া, অনিবন্ধিত হওয়া এবং অমানবিক জীবনযাপন ইত্যাদি সমস্যা আরও বাড়বে। তাই দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে।

অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, অতীতে অনিয়মের ঘটনায় যেসব রিক্রুটিং এজেন্সি জড়িত ছিল, তাদের দায়বদ্ধ করা উচিত ছিল। ২০২২ সালে শ্রমবাজার চালু করে নিয়োগপ্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করা হলো। কার্যত বন্ধ হয়ে গেল মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। একই অনিয়মে একই পরিণতি বরণ করতে হলো কর্মীদের। এবার যেন অন্তত জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা হয়।