চট্টগ্রামে এক বছরে মোটরসাইকেলে প্রাণ গেল ৮৩ জনের

চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় ট্রাকের নিচে চাপা পড়া একটি মোটরসাইকেল। ২২ জানুয়ারি ঘটে যাওয়া এ দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেলের তিন আরোহী নিহত হনফাইল ছবি

অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত আশরাফুল আলম। থাকত নগরের ওয়াজেদিয়া এলাকায়। মা–বাবার একমাত্র ছেলে বলে বেশ আদরে বড় হয়েছিল সে। প্রবাসী বাবার স্বপ্ন ছিল, ছেলে একদিন পড়াশোনা করে বড় কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করবে। হাল ধরবে পরিবারের। কিন্তু এক সড়ক দুর্ঘটনায় সব শেষ।

গত বছরের ১০ নভেম্বর চট্টগ্রামের হাটহাজারীর অক্সিজেন-কুয়াইশ সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয় আশরাফুল। সেদিন মোটরসাইকেলে আশরাফুলের সঙ্গী ছিল আলভী আহমেদ। সে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। দুই দিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছে ১৪ বছর বয়সী আশরাফুল। কিন্তু ফিরতে পারেনি। পরিবার ও চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এখন আশরাফুলকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা সাজেদা বেগম।

সম্প্রতি প্রথম আলোর কাছে ছেলের কথা বলতে গিয়ে গলা ভারী হয়ে আসে এ মায়ের। কোনোমতে নিজেকে সামলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ছেলেকে হারিয়ে পাগল হয়ে গেছি। পুরো ঘরজুড়ে তার স্মৃতি। চটপটে ছেলেটা এভাবে চলে গেল। আমি কী নিয়ে থাকব।’

শুধু আশরাফুল কিংবা আলভী নয়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে চট্টগ্রাম জেলায় ৩২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৮৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন ৪৪৩ জন। এর মধ্যে মোটরসাইকেলচালক ও আরোহী নিহত হয়েছেন ৮৩ জন। সর্বশেষ চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিন ব্যক্তি। লোহাগাড়া থেকে সাতকানিয়ার কেরানীহাট যাচ্ছিলেন তাঁরা। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই ট্রাকের নিচে চাপা পড়েন তাঁরা। পদুয়া নয়াপাড়া এলাকায় মোটরসাইকেলটিকে চট্টগ্রামমুখী একটি ট্রাক পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান পদুয়া ইউনিয়নের নয়াপাড়া এলাকার জালাল আহমদের ছেলে নুরুল আবছার (৪০), একই উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের সোলতান মৌলভির পাড়ার আবদুল কাদেরের ছেলে মো. জোবাইর (২৫) এবং রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দক্ষিণ রাজানগর এলাকার বাবুল মিয়ার ছেলে মো. জাহেদ (২৭)।

বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের বিশ্লেষণে দুর্ঘটনার এসব তথ্য উঠে এসেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের তথ্যের ভিত্তিতে দুর্ঘটনার এ হিসাব তৈরি করেছে সংগঠনটি। আজ শনিবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে চট্টগ্রামসহ সারা দেশের দুর্ঘটনার চিত্র তুলে ধো হয় সংগঠনটির পক্ষ থেকে।

সংগঠনটি বলছে, বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল ও ভারী যানবাহন চালানো, ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে চট্টগ্রামের সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা থামছে না। ফলে মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতি রোধ করা, ট্রাফিক আইন কড়াকড়ি করা ও সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে দুর্ঘটনা কমাতে হবে।

বেশি মৃত্যু মিরসরাইয়ে

সংগঠনের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলায় সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছেন। এ সংখ্যা ৫১। এ ছাড়া সীতাকুণ্ডে ৩৪, হাটহাজারীতে ২৭, পটিয়ায় ২৪, রাঙ্গুনিয়ায় ২১, চন্দনাইশে ১৯, লোহাগাড়ায় ১৮, রাউজানে ১৪, আনোয়ারায় ১০, সাতকানিয়ায় ৯, বোয়ালখালীতে ৮, বাঁশখালীতে ৭, ফটিকছড়িতে ৬, কর্ণফুলীতে ৬ ও নগরে ৩৫ জনের প্রাণ গেছে।

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জেলায় মৃত্যুর মধ্যে মোটরসাইকেলচালক ও আরোহী ছিলেন ৮৩ জন, যাত্রীবাহী বাস ও পণ্যবাহী যানবাহনের চালক ও যাত্রী ২৯ জন, পথচারী ৮৫, থ্রি–হুইলার যাত্রী ৯০ ও বাইসাইকেল আরোহী ২ জন নিহত হয়েছেন।

২২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার পুদুয়ায় ট্রাকের নিচে চাপা পড়া নিহত তিন মোটরসাইকেল আরোহীকে উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা
ফাইল ছবি

অন্যদিকে মহাসড়কে নিহত হয়েছেন ১৪৩ জন, আঞ্চলিক সড়কে ১১৫, গ্রামীণ সড়কে ১৩, শহরের সড়কে ১৫ জন ও কর্ণফুলী টানেলের সংযোগ সড়কে ৩ জন নিহত হয়েছেন।

অবশ্য গত বছর সবচেয়ে বড় সড়ক দুর্ঘটনাটি ঘটে ৭ নভেম্বর। সেদিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হাটহাজারীর চারিয়া এলাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার সঙ্গে বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের সাতজন নিহত হন। শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পরিবারের সবাই চন্দনাইশ থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে ফটিকছড়ির মাইজভান্ডারের শাহনগরে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সেই শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে কারও যাওয়া হয়নি। পথেই প্রাণ হারান সবাই।

দুর্ঘটনা যেসব কারণে

একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। এর মধ্যে রয়েছে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা এবং মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল।

সড়ক খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটরসাইকেল ও ভারী যানবাহন চট্টগ্রামের রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে চলাচল করে। কার আগে কে চালাবে, এমন একটা প্রতিযোগিতা থাকে। চালকদের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। পাশাপাশি চট্টগ্রামের সড়কগুলো পথচারীবান্ধব নয়। বেশির ভাগ ফুটপাত অবৈধ দখলে; যে কারণে অনেক ক্ষেত্রে মূল সড়ক দিয়ে হাঁটতে বাধ্য হন পথচারীরা। এতে চট্টগ্রামে গত এক বছরে ৮৫ জন পথচারী নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ছোট আকারের যানবাহনগুলো যেনতেনভাবে চলাচল করে।

দুর্ঘটনা কমাতে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। এর মধ্যে রয়েছে দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি; চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা; পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে, এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্বরাস্তা তৈরি করা।

জানতে চাইলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা দেশে সড়কের যে বিশৃঙ্খল অবস্থা, চট্টগ্রাম তার বাইরে নয়। চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক রাজধানী হলেও অনেক অপ্রশস্ত সড়ক রয়েছে। এতে দুর্ঘটনা ঘটেছে। ফলে সংগঠনের সুপারিশগুলো যথাযথ বাস্তবায়নের দাবি জানাই।’