আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে বিচারের অভাবে নাজুক মানবাধিকার পরিস্থিতি

  • মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিচারবহির্ভূত হত্যার বিচারে উদ্যোগ কম। বিচার পাওয়ার অধিকার নিয়েও রয়েছে সংশয়। নারী, শিশু ও শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করা এখনো চ্যালেঞ্জ।

  • ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো অস্বীকার করা হয়েছে। ফলে বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসপ্রতীকী ছবি

মানবাধিকার পরিস্থিতি সুরক্ষিত রাখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর সঠিক বিচার করা। এ বিচার পাওয়া ভুক্তভোগী ব্যক্তি ও তাঁদের স্বজনদের অধিকার। কিন্তু দেশে গুম-বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচার করা বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার নজির নেই বললেই চলে। ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহির আওতায় না আনায় নানামুখী অপরাধে জড়িয়েছেন তাঁরাও। সর্বশেষ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও তাদের সঙ্গে থাকা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নির্বিচার গুলি করার ঘটনাও অতীতের অপরাধের ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দেওয়ার চেষ্টার কারণে হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি ক্রমে নাজুক হয়েছে।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রয়োজন গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্বিচার গুলি করে মানুষ খুনের বিচার।

পরিস্থিতি নাজুক হওয়ার উদাহরণ হিসেবে আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ (আসক) বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রকাশ করা কিছু তথ্য উল্লেখ করা যায়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে তাদের করা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের টানা গত তিন মেয়াদে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে বিনা বিচারে ১ হাজার ৯২৬ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। গুম হয়েছেন সাত শতাধিক। এখনো প্রায় ২০০ জন নিখোঁজ। এর বাইরে পতিত সরকারের শেষ সময়ে ছাত্র–জনতার আন্দোলনে শত শত মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

এমন একটি প্রেক্ষাপটে আজ ১০ ডিসেম্বর পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘আমাদের অধিকার, আমাদের ভবিষ্যৎ, এই মুহূর্তে’।

মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র ১৯৪৮, রোম সংবিধি ১৯৯৮, আন্তর্জাতিক নির্যাতনবিরোধী সনদ ১৯৮৪, বাংলাদেশের সংবিধান, দণ্ডবিধি ১৮৬০ এবং আন্তর্জাতিক আদালতের পর্যবেক্ষণেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় বিচারের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো বলছে, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো অস্বীকার করা হয়েছে। ফলে বিচারপ্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ অবস্থায় মানবাধিকার পরিস্থিতি সুরক্ষিত রাখতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অতীত অপরাধগুলোর বিচার করা প্রয়োজন।

মানবাধিকার সুরক্ষিত রাখতে জুলাই–আগস্টের হত্যাকাণ্ডসহ অতীতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর বিচার করতে হবে। এখন যদি এ ধরনের অভিযোগ আসে, সেগুলোও শুনতে হবে।
সারা হোসেন, মানবাধিকারকর্মী ও অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক, ব্লাস্ট

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগীদের বিচারের দ্বার উন্মুক্ত হতে থাকে। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে চলা হত্যাকাণ্ডে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ শুরু হয়েছে। গুমের ঘটনাগুলোর তদন্তেও অন্তর্বর্তী সরকার একটি কমিশন গঠন করেছে। তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে কমিশন হয়নি। এ বিষয়ে সরকারের বিশেষ কোনো পদক্ষেপ এখনো দেখা যায়নি।

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানবাধিকার সুরক্ষিত রাখতে জুলাই–আগস্টের হত্যাকাণ্ডসহ অতীতের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর বিচার করতে হবে। শুধু অপরাধীদের সাজাই নয়, ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়াতে হবে।’
এই মানবাধিকারকর্মী আরও বলেন, ‘এখনো যদি কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আসে, সেগুলো শুনতে হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে তা অস্বীকারের জায়গায় চলে যাওয়া যাবে না।’

এখনো বিচার নিয়ে সংশ

দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও ভুক্তভোগীদের মধ্যে বিচার পাওয়া নিয়ে নানা সংশয় রয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এ সংশয় তৈরি হয়েছে কয়েকটি কারণে। অনেক ঘটনায় দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ায় দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে জটিলতা দেখা যাচ্ছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্ত সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কিছু মামলায় মূল অপরাধীদের সঙ্গে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা অসৎ উদ্দেশ্যে অন্যদের আসামি করায় তদন্তপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তা ছাড়া শেখ হাসিনা সরকারের পতনের চার মাস পরও অতীতের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার নির্দেশদাতা ও বাস্তবায়নকারীদের অনেকে এখনো গ্রেপ্তার না হওয়ায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।

ছাত্র–জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে রাজধানীর উত্তরার চারতলার বাসার বারান্দায় নিহত হয় এসএসসি পরীক্ষার্থী নাঈমা সুলতানা। তার মা আইনুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেভাবে পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারা হয়েছে, সেগুলোর বিচার হতেই হবে। এমনভাবে এদের বিচার করতে হবে, যেন ভবিষ্যতে কেউ কোনো মায়ের বুক খালি করার সাহস না পায়।’

মানবাধিকার কমিশনের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় অভিযোগ গ্রহণ ও তদন্ত করা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রধান কাজ। মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯–এর ১২ ধারা অনুযায়ী সঠিকভাবে অভিযোগগুলোর নিষ্পত্তির বাধ্যবাধকতা রয়েছে তাদের।

তবে ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত অভিযোগের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ ১২ বছরে কমিশনে ১৩ হাজার ২৮টি অভিযোগ জমা পড়ে (পূর্ববর্তী অনিষ্পন্ন অভিযোগসহ)। এ অভিযোগের বেশির ভাগই নিষ্পত্তি করা হয়নি। যেগুলোর নিষ্পত্তি হয়েছে, তা নিয়েও নানা ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। তা ছাড়া আইনে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা প্রয়োগ না করার অভিযোগও রয়েছে কমিশনের বিরুদ্ধে।

শুধু তা–ই নয়, অনেক সময় দায়সারাভাবে অভিযোগ নিষ্পন্ন করেছে মাবাধিকার কমিশন। অনেক অভিযোগ স্বীকারও করতে চায়নি তারা, যেমন ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে মানবাধিকার পরিস্থিতির মূল্যায়ন অংশে গুমের বিষয়ে আলাদাভাবে কিছু বলা হয়নি; বরং নিখোঁজ/অপহরণের পাশে বন্ধনী দিয়ে লেখা হয়েছে ‘কথিত গুম’। ২০১৯ সালে হাইকোর্ট এক রায়ে মন্তব্য করেছেন, মানবাধিকার কমিশন তাদের অর্পিত দায়িত্ব পালনে মারাত্মক গাফিলতির পরিচয় দিচ্ছে। কমিশন মানবাধিকার রক্ষায় ‘জেগে জেগে ঘুমাচ্ছে’।

মানবাধিকার কমিশন বিগত সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করেছে—এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ অবস্থার মধ্যেই আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ৭ নভেম্বর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও পাঁচজন অবৈতনিক সদস্য পদত্যাগ করেছেন। এরপর এক মাস পার হলেও নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

‘ক্রসফায়ার’ ও গুমের বিচার নিয়ে শঙ্কা

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশনে ১ হাজার ৬০০ অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী, পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এসব ঘটনায় জড়িত। তবে এখন পর্যন্ত গুমের ঘটনায় করা পৃথক দুটি মামলায় মাত্র দুজন পুলিশ কর্মকর্তাকে (র‍্যাবে কর্মরত ছিলেন) গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাঁরাও মূলত মধ্যম সারির কর্মকর্তা। গুমের পরিকল্পনাকারী হিসেবে বিভিন্ন সময়ে যাঁদের নাম এসেছে, তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এ অবস্থায় গুমের বিচার নিয়ে ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের স্বজনদের মধ্যে এখনো শঙ্কা রয়েছে। তাঁরা বলছেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অনেকে ইতিমধ্যে দেশ ছেড়েছেন। এ কারণে তাঁদের ফিরিয়ে এনে শাস্তি নিশ্চিত করা সহজ হবে না। তা ছাড়া গুমের অনেক আলামতও ধ্বংস করা হয়েছে। গুমের ঘটনাগুলোর বিচারে পৃথক আইন বা বিদ্যমান আইনের এ–সংক্রান্ত ধারাগুলো সময়োপযোগী করার পরামর্শ দিয়েছেন কেউ কেউ।
গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের অতীত ঘটনাগুলোর বিচার না হলে বর্তমান ও ভবিষ্যতে মানবাধিকার রক্ষার পথ সংকীর্ণ হয়ে যাবে। আমরা এ বিষয় মাথায় রেখে গুমের ঘটনায় সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করার কাজ করছি। যাঁরা দেশের বাইরে পালিয়েছেন, তাঁদের বিচারও আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকার। এ বিচার নিশ্চিত করতে গুমের আলামত যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য আমরা কঠোর বার্তা দিয়েছি।’

গত ১৫ বছরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর বিচার না হলে আমরা যে নতুন বাংলাদেশের কথা বলছি, তা স্বপ্নই রয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন ‘মায়ের ডাক’–এর সমন্বয়ক।

এদিকে গুমের ঘটনাগুলোর তদন্তে কমিশন হলেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত উদ্যোগ দেখা যায়নি। ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে বিচার ছাড়াই ১ হাজার ৯২৬ জনকে হত্যার ঘটনাগুলোর বিচার নিয়ে একধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ–সংক্রান্ত বেশ কিছু অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে ট্রাইব্যুনালে এ ধরনের কোনো ঘটনায় মামলা হয়নি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন আদালতে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু মামলা হয়েছে। সেই মামলা করতেও হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’–এর সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শেখ হাসিনার সময় বছরের পর বছর আমরা বিচারের জন্য অপেক্ষা করেছি। কিন্তু বিচার পাইনি। উল্টো নির্যাতন–নিপীড়ন বেড়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের চার মাস পরও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিচারে উল্লেখযোগ্য দৃশ্যমান কোনো ফলাফল আমরা দেখিনি। এ কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক ঘটনা এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা আড়ালেই রয়ে গেছেন।’

গত ১৫ বছরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর বিচার না হলে আমরা যে নতুন বাংলাদেশের কথা বলছি, তা স্বপ্নই রয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন ‘মায়ের ডাক’–এর সমন্বয়ক।