বান্দরবানের দিনমজুর মো. করিমের বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় কোনো মামলা নেই। গ্রেপ্তারও হননি কখনো। কিন্তু ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় মাদক আইনে গ্রেপ্তার এক আসামি জামিনে গিয়ে পলাতক হলে পুলিশ করিমকে গ্রেপ্তার করে। কারণ, সেই আসামি নিজের নাম–ঠিকানা গোপন রেখে করিমের নাম–ঠিকানা দেন। আর পুলিশও সঠিকভাবে তদন্ত না করে করিমকে ধরে নিয়ে আসে। বিনা অপরাধে ১১ দিন কারাবাস করতে হয় তাঁকে। তাঁকে ছাড়িয়ে নিতে মামলা চালাতে দেড় লাখ টাকা ঋণ করতে হয়েছে তাঁর পরিবারকে। এ জন্য সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চান করিম।
গত ২৯ জানুয়ারি তৃতীয় অতিরিক্ত চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ এইচ এম শফিকুল ইসলাম করিমকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন। পাশাপাশি আদালত মামলাটি পুনঃ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এবং মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছেন।
আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেছেন, প্রকৃত আসামির পরিচয় যাচাই-বাছাই না করে নিরপরাধ করিমকে মাদক মামলায় আসামি করায় তাঁর সামাজিক ও পারিবারিক মর্যাদাহানি এবং সাংবিধানিক অধিকারও ক্ষুণ্ন হয়েছে। যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার প্রকৃত আসামি জামিনে গিয়ে পলাতক রয়েছেন। পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তারের পর তার নাম-ঠিকানা সঠিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ না করে আসামির দেওয়া ভুয়া ঠিকানায় মামলা করে। পরে তদন্তেও ভুয়া ঠিকানায় অভিযোগপত্র দেয়। এটি পুলিশের চরম গাফিলতি। তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
ঘটনার শুরু ২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর। ওই দিন চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার পুঁইছড়ি ইউনিয়নের ফুটখালী ব্রিজের পাশ থেকে সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশায় অভিযান চালিয়ে তিন হাজার ইয়াবাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই ঘটনায় বাঁশখালী থানার এসআই লিটন চাকমা বাদী হয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেন। এতে কক্সবাজারের বাসিন্দা জসিম উদ্দিন, লক্ষীপুরের মো. হারুন ও বান্দরবানের করিমকে (আসামির দেওয়া তথ্য মতে) আসামি করা হয়। তদন্ত শেষে বাঁশখালী থানার এসআই দীপক কুমার সিংহ ওই তিনজনকে আসামি করে পরের বছরের ৩১ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেন। ২০২২ সালের ১৫ জুন জামিনে মুক্তি পান নিজেকে করিম নামে পরিচয় দেওয়া আসামি। কিন্তু পরে আদালতে হাজির না হওয়ায় তাঁর জামিন বাতিল করে ১ আগস্ট তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। পরোয়ানাটি বান্দরবানের আলী কদম থানায় করিমের ঠিকানায় গেলে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। এতে হতভম্ব হয়ে পড়ে তাঁর পরিবার। দিনে এনে দিনে খাওয়া পরিবারটি কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি গ্রেপ্তারের বিষয়ে। পরে এক পরিচিতের মাধ্যমে একজন আইনজীবী দেন মামলা লড়ার জন্য। গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হয়ে ২ অক্টোবর ১১ দিন কারাভোগ করে জামিনে মুক্তি পান নিরপরাধ করিম। আদালত ২৯ জানুয়ারি তৃতীয় অতিরিক্ত চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য রাখেন।
করিমের আইনজীবী মো. ওয়াহিদ ছায়েদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, করিম এই মামলার আসামি নয় উল্লেখ করে আদালতে তাঁর জামিনের আবেদন করা হয়। এতে বলা হয়, জামিনে গিয়ে পলাতক থাকা ব্যক্তি জামিননামায় টিপসই দিয়েছেন। আর গ্রেপ্তার করিম নিজের নাম লিখতে পারেন। পুলিশের কাছে প্রকৃত আসামির ছবি ছাড়া আর কোনো তথ্য নেই। আদালত চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ককে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার আসামি আর পরে গ্রেপ্তার হওয়া করিম একই ব্যক্তি কি না প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই ব্যক্তি একই ব্যক্তি নন। দুজনের চেহারার মধ্যে মিলও নেই।
এই মামলায় গ্রেপ্তার তিন আসামির মধ্যে জামিনে আছেন জসিম উদ্দিন। তিনি জানান, তাদের সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তি আর করিম একই ব্যক্তি নন। তাঁর ধারণা, এই ব্যক্তি রোহিঙ্গা নাগরিক।
তদন্তে গাফিলতি
ইয়াবাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাঁশখালী থানার এসআই লিটন চাকমা বাদী হয়ে মামলা করেন। একজন আসামি পরিচয় গোপন করে আরেকজনের (করিমের) ঠিকানা দিলেও পুলিশ তা সেই সময় ধরতে পারেনি। জানতে চাইলে মামলাটির বাদী লিটন চাকমা আজ বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অনেক চেষ্টা করি। তারপরও আসামি ভুল তথ্য দেয়।’ ৪০ দিন তদন্ত শেষে আসামির দেওয়া ভুল ঠিকানায় অভিযোগপত্র দেন একই থানার এসআই দীপক কুমার সিংহ। তখন আসামিরা কারাগারে ছিলেন। জানতে চাইলে বর্তমানে সীতাকুণ্ডের বারআউলিয়া হাইওয়ে পুলিশে কর্মরত এসআই দীপক কুমার সিংহ আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসামিদের নাম-ঠিকানা সঠিক আছে কি না, তা জানতে স্ব স্ব থানায় ইএস স্লিপ পাঠানো হয়। সেখান থেকে সঠিক আছে প্রতিবেদন আসায় ওই নামে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। গ্রেপ্তারের পর কারাগারে থাকা প্রকৃত আসামির জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই-বাছাই করা হলে সহজে পরিচয় শনাক্ত করা যেত কি না, প্রশ্নের উত্তরে তদন্তকারী কর্মকর্তা জানান তাঁর পরিচয়পত্র ছিল না।’
করিমের নাম-ঠিকানা সঠিক আছে প্রতিবেদন দেন আলীকদম থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) জসিম উদ্দিন। বর্তমানে তিনি বান্দরবানের রুমা থানায় কর্মরত। সরেজমিন তদন্ত করে করিমের নাম-ঠিকানা সঠিকের বিষয়ে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাইলে এএসআই জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সরেজমিন গিয়ে নাম–ঠিকানা সঠিক পাওয়া যায়। করিমের পরিবার মামলা নেই বললেও বিষয়টি কেন খতিয়ে দেখা হয়নি—প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেই সময় করিমের পরিবার কিছুই বলেনি। তবে করিম দাবি করেন, তাঁরা পুলিশকে বারবার বললেও শোনেনি। গরিবের কথা কে শোনে।
‘কৈফিয়ত দিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা বাধ্য’
আদালত সূত্র জানায়, তৃতীয় অতিরিক্ত চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ছিল মামলাটি। গত ২৯ জানুয়ারি আদেশে বিচারক উল্লেখ করেন, ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার আসামি নিজের পরিচয় গোপন করে আরেকজনের (করিম) পরিচয় ব্যবহার করায় নিরপরাধ হয়েও তাকে কারাবাস করতে হয়েছে। এতে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে তার মর্যাদাহানি হয়েছে। যার মাধ্যমে তার সাংবিধানিক অধিকারও ক্ষুণ্ন হয়েছে। যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। তদন্তকারী কর্মকর্তা নাম-ঠিকানা সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করে মনগড়াভাবে প্রকৃত আসামি গ্রেপ্তারের সময় যে ভুল ঠিকানা দিয়েছেন, সেটিই সঠিক উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা হাতেনাতে গ্রেপ্তার আসামির কাছ থেকে অন্যায়ভাবে লাভবান হয়ে সঠিকভাবে তদন্ত থেকে বিরত থেকেছেন অথবা তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্তকাজে সম্পূর্ণভাবে অদক্ষ একজন কর্মকর্তা।
মামলাটি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে আদেশে আরও বলা হয়, এমন একটি সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা তার যে অদক্ষতা কিংবা অসততার পরিচয় দিয়েছেন, তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাঁর অদক্ষতা কিংবা অসততার কারণে একজন নিরপরাধ সাধারণ জনগণের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।যার কৈফিয়ত দিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা বাধ্য। চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) দীপক কুমার সিংহের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা এসপিকে নির্দেশ দেওয়া হলো।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এস এম শফি উল্লাহ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আদালতের আদেশটি এখনো হাতে পায়নি। এটি পাওয়ার পর তদন্তকারী কর্মকর্তার বিন্দুমাত্র গাফিলতি পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মুখ দেখাতে পারেন না দিনমজুর করিম
নিরপরাধ হয়েও কারাভোগ করে বাড়িতে ফিরে এসে মানুষকে মুখ দেখাতে পারেন না জানান দিনমজুর মো. করিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক মানুষকে বোঝাতে পারি না আমি অপরাধী না। এ কারণে ঘর থেকে বের হয়ে মুখ দেখাতে পারি না। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে তার সম্মান ক্ষুণ্ন হয়েছে। কিন্তু বের না হয়ে উপায় নেই। স্ত্রী ও তিন সন্তানের সংসার চলে তার দিনমজুরিতে।’ তিনি এ ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তি চাওয়ার পাশাপাশি বিনা বিচারে তাঁকে আটকে রাখায় সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন।
পুলিশ সঠিকভাবে তদন্ত করলে দিনমজুর করিমকে কারাভোগ করতে হতো না বলে মন্তব্য করেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম জিয়াউদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মামলা করা থেকে শুরু করে তদন্ত প্রতিটি পর্যায়ে পুলিশের গাফিলতি উঠে এসেছে। সরেজমিন ঠিকানায় গিয়ে তদন্ত করলে নিরপরাধ ব্যক্তিকে কারাগারে যেতে হতো না। তদন্তে গাফিলতিকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা বাড়তে থাকবে। পার পেয়ে যাবে প্রকৃত আসামি।