দ্রুত পরিবর্তনশীল ও প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে গতিশীল ও বহুমুখী করতে রাসায়নিক পণ্য বড় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির প্রসার ঘটায় রাসায়নিকের চাহিদাও ব্যাপক হারে বেড়েছে। বিশ্বে রপ্তানিতে দ্বিতীয় স্থানে থাকা পোশাক ও টেক্সটাইল এবং ফার্মাসিউটিক্যালস শিল্পের দ্রুত সম্প্রসারণে এ খাতগুলোতে দেশে রাসায়নিকের চাহিদা তুলনামূলক বেশি। এ ছাড়া দেশে একাডেমিক প্রতিষ্ঠান ও টেস্টিং ল্যাবের সংখ্যাও অনেক বাড়ায় এখানেও বিপুল পরিমাণ রাসায়নিকের চাহিদা তৈরি হয়েছে।
রাসায়নিক শিল্প সারা পৃথিবীতে যেমন দ্রুত বাড়ছে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশেও এ শিল্পের পরিধি দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। গত দেড় দশকে রাসায়নিক পণ্য আমদানি পাঁচ গুণের বেশি বেড়েছে। এর বাজার বার্ষিক প্রায় ৮ শতাংশ হারে বেড়ে বর্তমানে প্রায় আড়াই শ কোটি ডলারের বেশি হয়েছে।
রাসায়নিকের কারণে ধারাবাহিক দুর্ঘটনার মধ্যেও আশার খবর হলো, বর্তমানে বাংলাদেশ হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড আমদানির বদলে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে এ রাসায়নিক রপ্তানি বাবদ আয় হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা।
তাই বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে রাসায়নিক শিল্প একটি সম্ভাবনাময় খাত। রাসায়নিকের এ বর্ধিত চাহিদা মেটাতে স্থল, নৌ ও বিমানবন্দর দিয়ে রাসায়নিক দ্রব্য আসছে এবং বিভিন্ন বন্দরে তা গুদামজাত করে রাখা হচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রায় ১৯টি বেসরকারি কনটেইনার ডিপোসহ বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং বেনাপোল স্থলবন্দরে রাসায়নিকের গুদাম আছে। এ ছাড়া পুরান ঢাকার নিমতলী, চুড়িহাট্টাসহ অনেক স্থানে শিল্পভিত্তিক রাসায়নিকের দোকান, কারখানা ও গুদাম রয়েছে। এসব স্থানে ৩১টি অতি দাহ্য রাসায়নিকসহ শিল্পে ব্যবহৃত প্রায় পাঁচ হাজার ধরনের রাসায়নিক থাকে।
দুঃখের বিষয় হলো, বাংলাদেশে বিভিন্ন শিল্প খাতে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উৎপাদন, পরিবহন ও সংরক্ষণ বা গুদামজাতকরণের সমন্বিত সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য কোনো সমন্বিত তদারকি নেই। নেই সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান। ফলে এ–সংক্রান্ত ছোট-বড় দুর্ঘটনা অহরহ ঘটছে, যা সম্ভাবনাময় রাসায়নিক খাতের সম্প্রসারণে অশনিসংকেত।
রাসায়নিকজনিত অগ্নিকাণ্ড
রাসায়নিকজনিত অগ্নিকাণ্ডে ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ১২৪ জন, ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টায় ৭১ জন মারা যায়। নিমতলী ও চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির মধ্যেও বিভিন্ন সময় ছোট ছোট অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। এ ছাড়া ২০২১ সালের ২৪ এপ্রিল আরমানিটোলায় রাসায়নিক গুদামে আগুনে চারজন এবং ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জে হাসেম ফুডস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জন মারা যায়।
চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি মাহুতটুলীর চারতলা ভবনে পলিথিন কারখানায়, ১৮ মার্চ আবারও নিমতলী এলাকায় প্লাস্টিকের পাইপের কারখানায়, ১৫ এপ্রিল লালবাগে একটি প্লাস্টিক কারখানায় এবং ২৪ মার্চ মৌলভীবাজারে তাজমহল টাওয়ারের পাশের ছয়তলা একটি ভবনে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, মৌলভীবাজারের ভবনটিতে অনেকগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থাকায় আগুন একটু ছড়িয়ে পড়লে আগের সব ট্র্যাজেডি ছাড়িয়ে যেতে পারত।
সর্বশেষ গত ৪ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ রাসায়নিক বিস্ফোরণে ১৩ জন প্রশিক্ষিত ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ ৪৯ জন নিহত হয়। এরপর রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবস্থাপনা নিয়ে আবারও প্রশ্ন উঠেছে, যা আমাদের জন্য সুস্পষ্ট ‘ওয়েক আপ কল’। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, গত ১০ বছরে দেশে রাসায়নিকের কারণে ছোট-বড় ১ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি অগ্নিকাণ্ড হয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে রাসায়নিক পণ্যের তদারকি ও বিধিবিধান
বাংলাদেশে বিস্ফোরক তৈরি, অধিকারে রাখা বা মজুত, ব্যবহার, বিক্রি, পরিবহন ও আমদানি-রপ্তানি করা হয় বিস্ফোরক আইন অনুযায়ী। বাংলাদেশে শিল্প খাতের প্রায় ৫৪ ধরনের অতি দাহ্য রাসায়নিকের আমদানির অনুমতি এবং লাইসন্সেসহ ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্ব বিস্ফোরক পরিদপ্তরের। শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত কিছু রাসায়নিকের দেখভাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও করে থাকে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের সব আইন, বিধি ও নিষেধ মোতাবেক রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শ্রমবিধি–২০১৫, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন–১৯৯৭ (সংশোধন ২০১০), পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা–১৯৯৭, এসডি কন্ট্রোল অ্যাক্ট-২০০২, বিসিক, ইউএন স্ট্যান্ডার্ডসহ সরকারের বিভিন্ন সময়ে স্বাক্ষর করা পরিপত্র বা অধ্যাদেশগুলোও প্রযোজ্য।
‘ডেঞ্জারাস কার্গোস অ্যাক্ট–১৯৫৩’ অনুযায়ী রাসায়নিক পণ্য সমুদ্রপথে পরিবহনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অনুমোদন নিতে হয়। সেখানেও কনটেইনার ডিপোতে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবস্থাপনা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। ১৯৯৮ সালে বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) স্থাপন ও পরিচালনার জন্য এনবিআর একটি নীতিমালা তৈরি করে। এ নীতিমালাতেও রাসায়নিক পণ্য মজুত, সংরক্ষণ ও পরিবহন নিয়ে সুনির্দিষ্টতার অভাব আছে বলে অনেকে মনে করেন।
এ ছাড়া বিপজ্জনক পণ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা প্রণীত ‘ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ডেঞ্জারাস গুডস বা আইএমডিজি কোড’ প্রযোজ্য। আবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের অধীনে বাংলাদেশ জাতীয় কর্তৃপক্ষ, রাসায়নিক অস্ত্র কনভেনশন (বিএনএসিডব্লিউসি) বন্দরের গুদামগুলো দেখভাল করে। তবে ডিপোতে দাহ্যজাতীয় বা রাসায়নিক পদার্থের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে বিস্ফোরক পরিদপ্তর ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে হয়। অর্থাৎ, রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত আইন, বিধিবিধান নেই। রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবস্থাপনা তদারকিও হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা দপ্তরের মাধ্যমে, যা এ খাতকে সম্প্রসারিত করার প্রধান অন্তরায়।
পুরান ঢাকা
পুরান ঢাকার ফ্ল্যাট, বাসাবাড়িতে অবৈধভাবে মজুত করা হয় রাসায়নিক পণ্য। পাশে থাকা ব্যক্তিও আন্দাজ করতে পারেন না যে তিনি দাহ্য বস্তুর সঙ্গে বসবাস করছেন, যেখানে বিশেষজ্ঞরা একেকটি বিশেষ ড্রামকে এক হাজার তীব্র বোমার চেয়েও শক্তিশালী বলে মনে করেন।
পুরান ঢাকাসহ রাজধানীতে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমোদিত গুদাম আছে ১৩৭টি। অথচ সেখানে প্রকৃতপক্ষে অবৈধ গুদাম আছে প্রায় ৫ হাজার। মার্কেট, জনবহুল বিপণিবিতানসহ প্রায় প্রতিটি বাড়ির নিচের বেজমেন্টের গুদামে রয়েছে অতি দাহ্য পদার্থ। এখানে অগ্নিকাণ্ড হলে নির্বাপণব্যবস্থা এবং রাস্তাঘাট সংকীর্ণ হওয়ার কারণে ফায়ার সার্ভিস পৌঁছানোর ব্যবস্থা না থাকায় তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। গত ১২ বছরে পুরান ঢাকার অগ্নিকাণ্ডে ঝরেছে দুই শতাধিক প্রাণ।
সীতাকুণ্ডের দুর্ঘটনা
যতটুকু জানা যায়, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ওই ডিপোর কনটেইনারগুলোতে কোনো ধরনের বিপজ্জনক চিহ্ন ছিল না। তদুপরি বিযোজনপ্রবণ ও বিপজ্জনক রাসায়নিকের জন্য কোনো হ্যাজকম জোন মার্কিং ছিল না। ফলে বিপজ্জনক রাসায়নিকের সঙ্গে গার্মেন্ট পণ্যসহ সব ধরনের কনটেইনার পাশাপাশি রাখা হয়েছিল। ডিপোতে নিজস্ব কোনো প্রশিক্ষিত ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা ছিল না। এ ছাড়া এসডিএস (সেফটি ডেটা শিট) ও জিএইচএস (গ্লোবাল হ্যাজার্ডাস সাইন) চিহ্ন না থাকায় কনটেইনারে কোনো রাসায়নিক আছে কি না, তা বুঝতেই পারেননি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
এ ক্ষেত্রে জারিকেনসহ কনটেইনারে প্যাকিং ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানের ছিল না বলে অনেকে মনে করেন। যেখানে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের মতো সংবেদনশীল রাসায়নিক তাপ ও ঘনমাত্রা নির্ভর, সেখানে রাসায়নিকগুলো সংরক্ষণে কোনো নিরাপদ ব্যবস্থা ছিল না। তাই উচ্চ তাপমাত্রা, উচ্চ ঘনত্ব, সঠিক মাত্রায় স্ট্যাবিলাইজার না থাকা, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের পিএইচ কাঙ্ক্ষিত না থাকা, এত দিন থাকার পরও কেমিস্ট দিয়ে এর গুণগত মান পরীক্ষা না করা এবং তদারকির অভাবসহ একসঙ্গে একটি কনটেইনারে ৬৮০টি জারিকেন রাখা সীতাকুণ্ডের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
নেতিবাচক দিক
২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি ভবিষ্যতে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে ১৭ দফা সুপারিশ করে। কিন্তু ওই সুপারিশ গত এক যুগেও বাস্তবায়ন না হওয়ায় পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় এত মানুষকে প্রাণ হারাতে হলো। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টায় ওই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরও ৩১ দফা সুপারিশ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি।
একইভাবে নিমতলী ও চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে কলকারখানা, গুদাম, কনটেইনার ডিপো ইত্যাদি স্থানে রাসায়নিকের মজুত, পরিবহন, সংরক্ষণ, বাজারজাত ও আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে তদারকি প্রক্রিয়া জোরদার করা হলে; রাসায়নিক ও দাহ্য বস্তু মজুত, অনুমোদন, লাইসেন্সিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে আরও অধিক তদারকি করা হলে, অগ্নিপ্রতিরোধব্যবস্থা ও ফায়ার সেফটি প্ল্যান নিশ্চিত করা হলে, আইন ও বিধিবিধান মেনে চলা ও দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হলে আজ সীতাকুণ্ডের রাসায়নিক বিস্ফোরণটি হয়তো ঘটত না কিংবা ঘটলেও যথাযথ প্রস্তুতি থাকার কারণে প্রশিক্ষিত ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ ৪৯ জনের প্রাণহানি হতো না।
ইতিবাচক দিক
২০১০ সালে নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডের পর রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নিতে রাসায়নিক শিল্পপল্লি গড়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে মুন্সিগঞ্জের ৩১০ একর জমিতে ১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়, যা এ বছরেই শেষ হওয়ার কথা। এ ছাড়া টঙ্গীতে ৫০টি ও শ্যামপুরে ১০টি অস্থায়ী গুদামের নির্মাণকাজও চলমান।
পুরান ঢাকায় অবৈধ রাসায়নিকের দোকান ও গুদামের ট্রেড লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন ২০১৮ সাল থেকে বন্ধ রেখেছে ফায়ার সার্ভিস ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের পর ওয়াহেদ ম্যানশনের আশপাশে অতি দাহ্য পদার্থের গুদামগুলো সরিয়ে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে।
রাসায়নিক পণ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য সুপারিশ
১. সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন এবং রাসায়নিক ও রাসায়নিকজাতীয় দাহ্য বস্তুর জন্য আলাদা দপ্তরের পরিবর্তে সব দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় সাধন।
২. রাসায়নিকের ধরন অনুযায়ী পাত্রের গায়ে, কনটেইনারে বা নোটিশ বোর্ডে জিএইচএস, এসডিএস ও টিডিএস (টেকনিক্যাল ডেটা শিট) চিহ্ন দিতে হবে, যাতে ব্যবহারকারী সহজেই রাসায়নিকটির ধরন বুঝতে পারেন।
৩. রাসায়নিক পদার্থ অবশ্যই আলাদাভাবে ও বিশেষভাবে নির্মাণ করা গুদামে সংরক্ষণ করতে হবে, যেখানে মুক্ত বায়ু চলাচল ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিষাক্ত পদার্থ এবং দাহ্য পদার্থ একসঙ্গে গুদামজাত করা যাবে না। হ্যাজকম জোন থাকতে হবে।
৪. রাসায়নিক হ্যান্ডলিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ফায়ার ফাইটিংয়ের ওপর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ ফায়ার এক্সটিংগুইশার মজুত রাখতে হবে।
৫. কোনো দুর্ঘটনা হলে তা মোকাবিলায় করণীয় এবং কীভাবে চিকিৎসা দিতে হবে, তার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ ছাড়া প্রতিটি সরকারি অফিস, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অগ্নিনির্বাপণ ও অগ্নিজনিত দুর্ঘটনা প্রতিরোধ এবং আত্মরক্ষামূলক প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
৬. কারখানায় ব্যবহৃত সব ধরনের আমদানি করা রাসায়নিক তালিকা করে রেজিস্ট্রারে লিখে রাখতে হবে।
৭. রাসায়নিক স্টোরে প্রতিদিন পরিদর্শন নিশ্চিত করতে হবে এবং তা রেজিস্ট্রারে লিখে রাখতে হবে।
৮. শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন প্রক্রিয়ার কারণে সৃষ্ট বর্জ্য অপসারণের জন্য ওই প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
৯. উন্নত মানের জারিকেন ও কনটেইনারে রাসায়নিক দ্রব্য আনা-নেওয়া ও সংরক্ষণ করতে হবে।
১০. পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, আবাসিক এলাকা থেকে দূরে গুদাম স্থাপন করতে হবে এবং অতিঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক সরকার অনুমোদিত গুদামে রাখতে হবে।
১১. রাসায়নিক রাখার স্থানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সব প্রস্তুতি রাখতে হবে।
১২. প্রতিটি রাসায়নিক শিল্পকারখানা, ডিপো ও গুদামে কেমিস্ট নিয়োগ দিতে হবে।
১৩. রাসায়নিক সংশ্লিষ্ট সব শ্রমিক ও কর্মচারী-কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
১৪. অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন–২০০৩ ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করতে হবে। একইভাবে অগ্নিনির্বাপণের আধুনিক এবং বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা প্রয়োগ করতে হবে।
১৫. নিরাপদ ও বিকল্প রাসায়নিক মূল্যায়ন ও ব্যবহারকে প্রাধান্য দিতে হবে।
১৬. জিরো ডিসচার্জের রোডম্যাপ অনুযায়ী রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট–এমআরএসএল, বায়ার কর্তৃক সার্টিফিকেট–আরএসএল, এপিও, এনপিও ইত্যাদি সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে শেয়ার করতে হবে।
১৭. যেকোনো রাসায়নিক পদার্থ সংরক্ষণ সব ধরনের নিরাপত্তা চেক লিস্ট সমর্থন করছে কি না, তা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমরা আগুন লাগার পর সচেতন হই। কিন্তু সঠিক সময়ে সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণেই ধারাবাহিক দুর্ঘটনা ঘটছে। আশা করি সীতাকুণ্ডে রাসায়নিকজনিত বিস্ফোরণ আমাদের জন্য এ ধরনের শেষ ঘটনা। রুটিন বিরতিতে একের পর এক অগ্নিকাণ্ড হলেও রাসায়নিক উৎপাদন, মজুত, পরিবহন ও হ্যান্ডলিংয়ের বিষয়ে কোনো যুগোপযোগী নীতিমালা তৈরি হয়নি। রাসায়নিক সামগ্রী সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য আশু করণীয় নির্ধারণ জরুরি।
সে ক্ষেত্রে ওপরের সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করা যেতে পারে। মানবাধিকারকর্মীদের মতে, এ ধরনের ‘কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড’ বন্ধ করতে প্রয়োজন রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন, পরিবহন, গুদামজাতকরণে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন ও সমন্বিত বিধিবিধান বা নীতিমালা। আধুনিক যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাসায়নিক আমদানি-রপ্তানিও পরিচালিত হবে—এটাই প্রত্যাশা।