রুদ্ধশ্বাস সেই রাত

জোহরা তাজউদ্দীন

ভয়াবহ ২৫ মার্চ সকালে আমার স্বামী তাজউদ্দীন (তাজউদ্দীন আহমদ) আমাকে বলেছিলেন, ‘লিলি, আজ রাতে আমি বাসায় থাকব না, তোমরাও কেউ বাসায় থেকো না।’ রাত ১০টার পরে তাজউদ্দীন বাসায় ফিরলেন। দেখলাম গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন তাঁর মুখমণ্ডল। উপস্থিত সবাই চলে গেলে তিনি বাসার শানের খোলা জায়গায় পায়চারি করতে থাকলেন। একটু পর আমাকে বললেন কাপড়ের ব্যাগটাতে একটা লুঙ্গি, গেঞ্জি আর রাইফেলের কিছু গুলি রাখতে।

ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও ড. কামাল হোসেন এলেন। তিনি তাঁদের সঙ্গে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলেন। আমার কানে ভেসে এল, ‘আমি চলে যাচ্ছি।’ দেখলাম, তাঁদের গাড়িটা দ্রুতবেগে ধানমন্ডির ১৫ নম্বর রোড পর্যন্ত গেল। এরপর গাড়ি ঘুরিয়ে উল্টো দিকে লালমাটিয়ার দিকে গেল। দূর থেকে গোলাগুলি ও মর্টার আক্রমণের শব্দ শুনতে পেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই নজরে পড়ল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাদের কয়েকটি গাড়ি আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে তীব্র বেগে লালমাটিয়ার দিকে চলে গেল। অজানা আশঙ্কায় আমি কেঁপে উঠলাম।

তাজউদ্দীন চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে আমি বাচ্চা দুটি নিয়ে আমাদের গাড়িতে উঠেই ড্রাইভারকে বললাম, যত তাড়াতাড়ি পারো সামনেই অর্থাৎ উল্টো দিকে ২১ নম্বর রোডের ভেতর ঢুকে পড়ো। ওখানে যেকোনো একটি বাড়িতে আমি নেমে যাব। এ সময় ভীষণ গোলাগুলির শব্দ হচ্ছিল আশপাশে। একটু পর দেখলাম ইলেকট্রিক ও টেলিফোনের তার ছিঁড়ে পড়তে।

তখন আমাদের বাড়িটি ছিল দোতলা। আমরা নিচতলায় থাকতাম। দোতলায় ভাড়াটে হিসেবে থাকতেন আবদুল আজিজ বাগমার ও তাঁর স্ত্রী আতিয়া আজিজ। আজিজ সাহেবের পৈতৃক বাড়ি ছিল কালীগঞ্জে [গাজীপুর জেলার অন্তর্গত]। তিনি একসময় ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন।

তখনই আজিজ ভাই ও আতিয়া প্রায় দৌড়ে এসে ভীষণভাবে বাধা দিলেন আমাকে। চাপা গলায় বললেন, ভাবি, একমুহূর্ত দেরি না করে গাড়ি থেকে নেমে আসুন। গেটের বাইরে গেলেই মিলিটারির হাতে ধরা পড়ে যাবেন। বুঝতে পারলাম, পালানোর পথ রুদ্ধ। দ্রুত চিন্তা করছিলাম এখন কী করা যায়। গাড়ি থেকে নেমে সিঁড়িঘরের আড়ালে গিয়ে আতিয়াকে বললাম, আমি তোমাদের সঙ্গে ওপর তলাতেই যাই আর আমিও ভাড়াটে সেজে পড়ি।

আতিয়া ও আমার ভালো উর্দু জানা ছিল। ওপরে গিয়ে দ্রুত সালোয়ার ও কামিজ পরে দুজনেই নিজেদের বেশ পরিবর্তন করে ফেললাম। সালোয়ার–কামিজ পরে দৈহিক উচ্চতা ও আকৃতিতে আমাদের দুজনকেই অবাঙালির মতো দেখাচ্ছিল।

চারদিকে এবং দূর থেকে গুলি ও আরও সব বিকট শব্দ ভেসে আসছিল। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখলাম আকাশ আলোয় ভরা। এরপর জানালা থেকে সরে এসে দেখলাম বড় হলঘরে আতিয়া ও আজিজ ভাই তাঁদের শোবার ব্যবস্থা করছেন দুটি সোফার ওপরে। এর মধ্যে গোলাগুলির শব্দ ক্রমশ নিকটবর্তী হতে লাগল। আতিয়াকে নিয়ে এক ঘরেই থাকলাম।

দক্ষিণের জানালার ফাঁক দিয়ে আবার বাইরে তাকালাম। অভাবনীয় দৃশ্য চোখে পড়ল। দেখলাম দক্ষিণের সারাটা আকাশ লালে লাল। পরপর অনেক গাড়ি আমাদের বাড়ির সামনে থামার শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হলো আমাদের গোটা বাড়ি যেন মিলিটারিরা ঘিরে ফেলেছে। সত্যি সত্যি ওরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়িতে ঢুকে পড়ল।

শব্দে বুঝতে পারছি পাকিস্তানি সেনারা গুলির আঘাতে ঘরের দরজা-জানালা ও বারান্দার মোটা তারের বেড়াগুলো ভেঙেচুরে তছনছ করে দিচ্ছিল আর নিচের প্রতি ঘরে ঢুকে তাজউদ্দীন ও আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।

পাকিস্তানি সেনারা আব্বা ও বারিক মিঞার হাত বেঁধে ঘিরে দাঁড়িয়ে আমরা কোথায় চিৎকার করি তা জানতে চাইছিল। একটি দল সিঁড়ির দরজা ভেঙে চুরমার করে দোতলার বারান্দায় প্রবেশ করে। মনে হলো সেনাদের একাংশ দোতলার ছাদের দিকে ছুটে গেল।

সেনাদের দল আমি ও আতিয়া যে ঘরে ছিলাম, সে ঘরের দরজায় বিকট শব্দে এক ধাক্কা দিতেই আতিয়া ‘কৌন হ্যায় জি’ বলেই দরজা খুলে দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে চার-পাঁচজন পাকিস্তানি সেনা ঘরে ঢুকেই তাদের অস্ত্র আমাদের বুকের দিকে তাক করে দাঁড়াল। অফিসার মতো একজন প্রশ্ন করল, ‘তাজউদ্দীন কিধার হ্যায়? মিসেস তাজউদ্দীন কৌন হ্যায়? তুম ইয়া তুম...।’ কয়েকজন আবার জানালার কাছে গিয়ে বাইরে গুলি করল। আতিয়া উত্তর দিল, ‘আরে জি ইহা মিসেস তাজউদ্দীন কাহা হ্যায়, আপ ইয়ে কেয়সা গালতি বাতা রাহে! হাম সাব টিমেন্ট হ্যায়, তাজউদ্দীন হামারে ল্যান্ডলর্ড, উনহোনে তো জি গ্রাউন্ড ফ্লোরমে রাহতে।’

নিচে আমার ছবি দেয়ালে টাঙানো আছে। এ কারণে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আমার ছেলেটা কোলেই ছিল। দ্রুত ওকে আমার মুখের সামনে নিয়ে আমার মুখটা কিছুটা আড়াল করে আতিয়ার উত্তর শেষ হওয়ামাত্র আতিয়াকে আমি ধমকের সুরে বললাম, ‘আরে জি তুমহে তো পাহেলেই মানা কিয়েথে ইয়ে সাব পলিটিশিয়ানকে ঘর কেরায়া নেহি লেনা, আখেরি এহি থা নাসিবমে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন...।’ আমার কথা শেষ হওয়ামাত্রই যে অফিসারটি রাগের ভঙ্গিতে কথা বলছিল, সে তার অস্ত্র নামিয়ে ফেলে আমাদের দুজনের দিকে তীক্ষ্ণ একপলক দৃষ্টির ঝাপটা রেখেই বলল, ‘হামারা গালতি হো গিয়া আপলোগ ইতমিনানসে রাহিয়ে, মুঝে আওর কুচ কারনা নেহি।’

অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি উদয়ের পথে থেকে

জোহরা তাজউদ্দীন: তাজউদ্দীন আহমদের সহধর্মিণী; আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। ২০১৩ সালে তিনি প্রয়াত হন।