মিরসরাইয়ের যে দিঘির সঙ্গে জড়িয়ে আছে চার শ বছরের ইতিহাস
দিঘির টলটলে জলে মাছখেকো পাখিদের দাপাদাপি। বক, মাছরাঙা, পানকৌড়ি আর চিল কী নেই। জলছোঁয়া শীতল বাতাস প্রশান্তি দেয় পথিকের গায়ে। শত শত বছর ধরে গ্রামের মানুষের পানির সংস্থানের বড় উৎসও এ দিঘি। ৪০০ বছরের প্রাচীন নিদর্শন এই দিঘি ইতিহাসের এক জীবন্ত সাক্ষী। ঐতিহ্যবাহী এই দিঘির নাম পরাগল খান দিঘি। এর অবস্থান চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের পরাগলপুর গ্রামে।
বাংলায় স্বাধীন সুলতানি আমলে খনন করা দিঘিগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম দিঘি হিসেবে ধরা হয় পরাগল খান দিঘিকে। হোসেন শাহি বংশের প্রতিষ্ঠাতা (১৪৯৪-১৫১৯) আলাউদ্দিন হোসেন শাহ চট্টগ্রাম বিজয় করে লস্কর উপাধি দিয়ে পরাগল খানকে বাংলা সালতানাতের প্রশাসক ও সামরিক কমান্ডার নিযুক্ত করেন। দায়িত্ব পাওয়ার পর আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সামরিক সেনাপতি পরাগল খান মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ এলাকায় তার রাজনৈতিক সদর দপ্তর স্থাপন করেন।
স্থানীয় মানুষের প্রয়োজনের কথা ভেবে এ অঞ্চলে পরাগল খান একটি সুবিশাল দিঘি খনন করেন। তার নামানুসারেই দিঘিটির নাম হয়ে যায় পরাগল খান দিঘি।
১৫ শতকের শেষ দিকে পরাগল খান এ দিঘিটি খনন করেন হয় বলে ধরা হয়। ২৯ দশমিক ৬০ একর জমির ওপর খনন করা দিঘিটির দৈর্ঘ্য ৪৩৭ দশমিক ৩৯ মিটার, প্রস্থ ২৭১ দশমিক ৫৮ মিটার। একসময় চারপাশে টিলাসমান উঁচু পাড় থাকলেও বছর বছর বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে এখন অনেকটাই নিচু হয়ে এসেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এ দিঘির পূর্ব পাড়ে একটি মসজিদ ছিল বলে জানা যায়। যা ধ্বংস হয়ে এখন কেবল তার কিছু নমুনা অবশিষ্ট আছে।
আজ বুধবার ভোরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দিঘিটির পশ্চিম পাড়জুড়ে এখন মানুষের বসতি। উত্তর পাড়ের পাশ দিয়ে গেছে একটি পাকা রাস্তা। দক্ষিণ ও পূর্ব পাড় দুটি এখনো বেশ উঁচু। এ দুটি পাড়ে আছে নানা প্রজাতির গাছপালা। সেসব গাছে দেখা গেল নানান জাতের পাখির উপস্থিতি। দিঘিটিতে এখন বাণিজ্যিক মাছ চাষ করছেন পরাগল খানের বংশধরেরা। পূর্ব পাড়েই গড়ে তোলা হয়েছে একটি মাছের পোনা উৎপাদনের হ্যাচারি ও একটি ছোট ফিডমিল। এসব করতে কেটে সমান করা হয়েছে দিঘির পূর্ব পাড়ের কিছু অংশ।
দিঘি সম্পর্কে জানতে চাইলে জোরারগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বলেন, ‘পরাগল খান দিঘি এত বড় যে এক পাড় থেকে আরেক পাড় স্পষ্ট দেখা যায় না। ছোটবেলায় এ দিঘি নিয়ে কত রূপকথা শুনেছি। মানুষ বলত রাতে রাতে জিনরা খনন করে দিয়ে গেছে এ দিঘি। এখন প্রায়ই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ দিঘি দেখতে আসে মানুষ।’
মিরসরাইয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি জামশেদ আলম বলেন, ‘পরাগল খান দিঘি দেশের ইতিহাসের অংশ। এত সুবিশাল দিঘি আমাদের এ অঞ্চলে আর দ্বিতীয়টি নেই। এখন বাণিজ্যিক ব্যবহারে এনে নানাভাবে দিঘিটির রূপ পরিবর্তন আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। এ সম্পদ কোনোভাবেই যাতে বিনষ্ট না হয়।’