শত প্রতিকূলতায় টিকে আছে মিরসরাইয়ের ঢাকি নাটক

জমজমাট ঢাকি নাটকের একটি বিশেষ মুহূর্ত। সম্প্রতি মিরসরাই উপজেলায়ইকবাল হোসেন

জারি-সারি, যাত্রাপালা, পালাগান, বাইচের গান, গড়িয়া নাচের মতো গ্রামীণ সংস্কৃতির অনেক অনুষঙ্গ এখন আর সেভাবে চর্চিত হয় না। কৃষিভিত্তিক সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন ও আকাশ সংস্কৃতির চাপে দেশের বেশির ভাগ গ্রামে এখন আর এসব দেখা যায় না। তবে সব হারানোর মধ্যেও চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে এখনো টিকে আছে হাজার বছরের ঐতিহ্য ঢাকি নাটক। প্রতিবছর চৈত্র মাসের শেষ দিকে ঢাক বাজিয়ে রামায়ণ-মহাভারতের নানা অংশ পালা আকারে পরিবেশন করা হয় বাড়ি বাড়ি গিয়ে।

মিরসরাই উপজেলার সোনাপাহাড়, গোপীনাথপুর, চিনকিরহাট ও আজম নগর এলাকায় এখনো কয়েকটি ঢাকি দলের দেখা মেলে। নাটকের কুশীলবেরা নানা পেশায় জড়িত। কাজের অবসরে নাটকে অংশ নেন তাঁরা। মূলত রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনির অংশবিশেষ পালা আকারে পরিবেশন করা হয়। রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবেশন করা হয় এই নাটক। বাড়ির বাসিন্দারা ছাড়াও নাটক দেখতে ভিড় জমান সাধারণ গ্রামবাসী ও পথচারীরা। নাটকের দলে ঢাক বাদক বা ঢাকিদের বড় ভূমিকা থাকে। আর এ কারণেই হয়তো এই নাটকের এমন নামকরণ।  

মধ্যরাতে গ্রামের যেকোনো একটি বাড়ির আঙিনায় নাটকের মঞ্চায়ন হয়। ওই বাড়ির বাসিন্দারা ছাড়াও ঢাকি দলের পরিবেশনা দেখতে ভিড় করেন গ্রামের সাধারণ বাসিন্দারা। সম্প্রতি মিরসরাইয়ে
ইকবাল হোসেন

এ বছর উপজেলার জোরারগঞ্জের দক্ষিণ দেওয়ানপুর গ্রামের ঢাকি দল পরিবেশন করছে ‘রাম-রাবণের যুদ্ধ’ নামের নাটক। ১৫ জন স্থানীয় নাট্যকর্মী নিয়ে করা এ নাটকের নির্দেশনায় আছেন গ্রামের বাসিন্দা হীরালাল দেবনাথ। পেশায় পোস্টমাস্টার ৫৫ বছর বয়সী হীরালাল ২৫ বছর ধরে যুক্ত আছেন এ ঢাকি নাটকের সঙ্গে।

৮ এপ্রিল সকালে দক্ষিণ দেওয়ানপুর গ্রামের বাড়ি গিয়ে কথা হয় এ নাট্যকারের সঙ্গে। তিনি জানান, নাটকের কুশীলবদের সবাই এ গ্রামেরই মানুষ। কেউ ছাত্র, কেউ চা–দোকানি, কেউ চিকিৎসক, কেউ–বা কাঠমিস্ত্রি। দিনে সবাই যাঁর যাঁর কাজে ব্যস্ত থাকেন। রাতে বিভিন্ন গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবেশন করা হয় নাটক। প্রতিবছর চৈত্র মাসের শেষ দুই সপ্তাহ রাত দশটা থেকে ভোর পর্যন্ত প্রদর্শন করা হয় নাটক। যে বাড়িতে নাটক দেখানো হবে, শুরুতে সেখানে গিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে সে বাড়ির মানুষদের ঘুম থেকে জাগানো হয়। এরপর বাড়ির আঙিনায় শুরু হয় নাটক পরিবেশনা। একেক বাড়িতে দেখানো হয় নাটকের একেক অংশ। প্রতি রাতে চার থেকে পাঁচটি বাড়ি ঘুরে আসে নাটকের দল। রাত নয়টা থেকে শুরু হয় পোশাক পরা ও প্রসাধন নেওয়ার কাজ। যন্ত্রীদল ঠিকঠাক করে নেন সব বাদ্যযন্ত্র। রাতে হেঁটে হেঁটে আশপাশের গ্রামগুলোর বাড়ি বাড়ি যান নাটক দলের সদস্যরা। নাটক দেখানো শেষে দর্শকদের কাছ থেকেই সম্মানী নেন কুশীলবেরা। নাটক দেখে খুশিমনেই তাঁদের টাকা দেন ঘরের লোকজন।

ঢাকি দলের তিন কুশিলব। সম্প্রতি মিরসরাইয়ে
ইকবাল হোসেন

৯ এপ্রিল রাত ১২টায় দেওয়ানপুর বণিকপাড়ার একটি বাড়িতে প্রদর্শিত হয় ‘রাম-রাবণের যুদ্ধ’ পালার একটি অংশ। ঢাকঢোলের আওয়াজে ছুটে আসেন আশপাশের বাড়ির মানুষও। মুহূর্তেই বাড়িটির আঙিনায় জড়ো হয়েছেন শিশু, নারী-পুরুষসহ শ খানেক দর্শক। নাটকের নানা পর্যায়ে দর্শকেরা তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানাতেও ভুল করেন না। কখনো কোনো দৃশ্যে আবেগে চোখের জল ঝরে তো, কোনো দৃশ্যে হাসিতে ফেটে পড়েন তাঁরা। নাটক শেষে প্রতিটি ঘর থেকে সম্মানী দেওয়া হয় কুশীলবদের।

নাট্যকার হীরালাল দেবনাথ বলেন, ‘এ ঐতিহ্য ধরে রাখা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। এ নাটক দিয়ে নতুনদের তেমন আগ্রহ নেই। অনেক বলেও দলে আনা যায় না। তবু হাল ছাড়ছি না। যত দিন সম্ভব আমরা বুকে আঁকড়ে ধরে রাখব শত বছরের এ আবেগ।’