নজরুল চেয়েছিলেন আত্মপরিচয়ে বাঙালি বড় হয়ে উঠুক

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত একক বক্তৃতায় বক্তব্য দিচ্ছেন রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ। আজ বাংলা একাডেমিতেছবি: প্রথম আলো

‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’—কাজী নজরুল ইসলাম অতি সহজ করে এই কথা বলেছিলেন। ইউরোপের রেনেসাঁর প্রধান বিষয়টিই ছিল মানুষ, মানবিকতা। সেখানে বলা হয়েছিল, সব ভাবনা ও বিবেচনার কেন্দ্রে থাকবে মানুষ। নজরুল খুব সহজ ভাষায় কথাটি বলেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, ধর্মান্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালি তার নিজের শক্তিতে আত্মপরিচয়ে বড় হয়ে উঠুক।
আজ বৃহস্পতিবার বাংলা একাডেমি আয়োজিত একক বক্তৃতায় রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ কবি নজরুল সম্পর্কে এই মূল্যায়ন করেছেন। জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকী আগামী শনিবার। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি একক বক্তৃতা ও ‘নজরুল পুরস্কার’ প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

বেলা ১১টায় একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। স্বাগত বক্তব্য দেন ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মোবারক হোসেন। একক বক্তৃতা, পুরস্কার প্রদানের সঙ্গে নজরুল সংগীত ও কবিতা আবৃত্তি দিয়ে সাজানো হয়েছিল অনুষ্ঠান।

‘নজরুলের চেতনালোক, আমাদের অবলোকন বনাম কবির কথন’ শীর্ষক বক্তব্যে সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ বলেন, ‘নজরুলের প্রসঙ্গ এলে প্রথমেই তাঁর “বিদ্রোহী” ভাবমূর্তি আমাদের মনে পড়ে। বিদ্রোহী বলতে সাধারণত বুঝি যারা নিয়ম মানে না, উচ্ছৃঙ্খল তাদের। কিন্তু নজরুল প্রথম জীবনে ছিলেন সৈনিক। সেখানে তিনি শৃঙ্খলার অনুশীলন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর এই বিদ্রোহ ছিল সমাজের বৈষম্য, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ, শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে। খুবই সাহসী ছিলেন তিনি। কঠিন সত্য কথা খুব সহজ করে সরাসরি বলেছেন। কারও কোনো পরোয়া করেননি। বলেছেন, ভবিষ্যতে কেউ মনে রাখুক বা না–রাখুক তিনি তাঁর কথা বলে যাবেন। সে কারণে অনেকেই তাঁকে সমালোচনা করে বলেছেন, তিনি সমকালীন কবি। তাঁর লেখায় উঁচু দরের বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ নেই। কিন্তু কঠিন কথা সহজ করে বলা সহজ নয়। নজরুল সেই কাজটিই করেছেন। সে কারণেই এখনো প্রাসঙ্গিক হয়ে আছেন।’

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

আলোচক আরও বলেন, ‘নজরুলের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, তিনি যেমন ধর্মীয় ভেদাভেদ ও আর্থিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে সমতার সমাজ গড়তে চেয়েছেন, তেমনি নারী ও পুরুষের মধ্যেও সমতার কথা বলেছেন। কবি বলেছেন, তাঁর চোখে নারী ও পুরুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। পৃথিবীর সব কল্যাণকর কাজে পুরুষের মতো সমান অবদান নারীরও রয়েছে। আজ আমরা যে লিঙ্গসমতার দাবিতে আন্দোলন করছি, নজরুল বহু আগেই তাঁর রচনায় এই কথা স্পষ্ট করে তুলে ধরেছিলেন।’

কবিকে নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্নজনের সমালোচনা, কবির নিজের রচনার উক্তি, উদ্ধৃতি ও বক্তা তাঁর নিজের বিশ্লেষণ মিলিয়ে মনোজ্ঞ এই বক্তৃতায় বলেছেন, ‘নজরুলকে একটা সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলেছিল। আবার তাঁকে কাফের আখ্যাও দেওয়া হয়। রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য একসময় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ তাঁকে নিজেদের দলে টানার চেষ্টা করেছে। কিন্তু দলীয় সংকীর্ণতায় নজরুল নিজেকে আবদ্ধ করেননি। সাম্যবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হলেও কমিউনিস্ট পার্টিতেও তিনি যোগ দেননি। তিনি সর্বাত্মকভাবে চেয়েছেন হিন্দু-মুসলিম তাদের মিলিত শক্তিতে বাঙালিত্বের পরিচয়টি প্রধান করে তুলে ধরুক। পাশাপাশি তিনি সত্য ও সুন্দরের সাধনা করে গেছেন। পরীক্ষার খাতায় নজরুল সম্পর্কে চূড়ান্ত মন্তব্য করে আমরা যেমন তাঁর কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে লিখি, “মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ–তূর্য” কবির সম্পর্কে এটা আমারও শেষ কথা,’ এই বলে বক্তা আলোচনার দাঁড়ি টেনেছিলেন।

সভাপতির বক্তব্যে সেলিনা হোসেন বলেন, ‘নজরুল ইসলাম তাঁর সাহিত্যের মাধ্যমে আমাদের জাতিসত্তাকে আলোকিত করেছেন। আমাদের মানসলোকের দিগন্ত প্রসারিত করেছেন। নতুন প্রজন্ম তাঁর সাহিত্যের মাধ্যমে নিজেদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রেরণা লাভ করবে।’

আলোচনার পর নজরুল–সাহিত্য নিয়ে অবদান রাখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানাকে নজরুল পুরস্কার ২০২৪ প্রদান করা হয়। বাংলা একাডেমি ২ লাখ টাকা আর্থিক মানের এই পুরস্কার প্রবর্তন করেছে ২০২২ সালে। অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা বিদেশে অবস্থান করায় তাঁর পক্ষে পুরস্কার গ্রহণ করেন তাঁর আত্মীয় ড. মোমেনা খাতুন।

অনুষ্ঠানের শুরুতে সংগীত পরিবেশন করেন লীনা তাপসী খান, প্রদীপ কুমার নন্দী ও রওশন আরা। আবৃত্তি করেন ডালিয়া আহমদ।