বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির সমবণ্টন জরুরি

‘ভবিষ্যতের পানি সুরক্ষা: বরেন্দ্র অঞ্চলের সহনশীলতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো, ব্র্যাক ও ওয়াটারএইড।

উপরে বাঁ থেকে রেজাউল মাকছুদ জাহেদী ও আনোয়ার জাহিদ; নিচে বাঁ থেকে হাসিন জাহান ও লিয়াকত আলী
ছবি: প্রথম আলো

দেশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে। এই সংকট প্রকট বরেন্দ্র অঞ্চলে। এই অঞ্চলে খাবার পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠছে। চাষাবাদের জন্যও পানি যাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলে যতটুকু পানি আছে, তার সমবণ্টন নিশ্চিত করতে হবে।

‘ভবিষ্যতের পানি সুরক্ষা: বরেন্দ্র অঞ্চলের সহনশীলতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব বিষয় উঠে এসেছে। গতকাল সোমবার বিকেলে রাজধানীর গুলশান–২–এর ক্রাউন প্লাজায় প্রথম আলো, ব্র্যাক ও ওয়াটারএইড যৌথভাবে এ বৈঠকের আয়োজন করে।

গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে। ফলে এই সংকট মোকাবিলায় ওই অঞ্চলের ভূ–উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে।

এই আয়োজনে পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার মহাপরিচালক মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী বলেন, পানি সুরক্ষার জন্য দেশে যেসব বিধিবিধান রয়েছে, তা অত্যন্ত সুন্দর; কিন্তু এর প্রয়োগে সমস্যা রয়েছে।

বরেন্দ্র অঞ্চলের আটটি উপজেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের অবস্থা খুবই খারাপ, সেখানকার ৪১ ভাগ মানুষ খাবার পানি পাচ্ছেন না বলেও উল্লেখ করেন রেজাউল মাকছুদ জাহেদী। তিনি বলেন, বরেন্দ্র এলাকায় খাদ্যনিরাপত্তার চেয়ে খাওয়ার পানির নিরাপত্তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি উপজেলায় একটি করে খাল সংরক্ষণ করতে হবে, যা গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা যাবে। তিনি বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি রক্ষা করার প্রতি জোর দেন।

এই আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূগর্ভস্থ পানিবিজ্ঞান পরিদপ্তরের পরিচালক আনোয়ার জাহিদ। গবেষণার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রায় দুই–তৃতীয়াংশ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্থায়ীভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। অর্থাৎ বর্ষায় পানির স্তর যে পর্যায়ে চলে আসার কথা, তা আসছে না। সেখানে পানির স্তর ৩৫–৪০ মিটার নিচে নেমে গেছে। ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূ–উপরিস্থ পানি বেশি বেশি ব্যবহার করতে হবে। সেই সঙ্গে কম পানি দিয়ে যেসব ফসল চাষ করা যায়, সেদিকেও যেতে হবে।

বরেন্দ্র এলাকায় খাদ্যনিরাপত্তার চেয়ে খাওয়ার পানির নিরাপত্তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি উপজেলায় একটি করে খাল সংরক্ষণ করতে হবে, যা গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা যাবে।
মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী, মহাপরিচালক, পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা

ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান বলেন, চাষাবাদের জন্য বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ যেমন পানি তুলছে, তেমনি বেসরকারিভাবেও তোলা হচ্ছে। বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ চাষাবাদের পাশাপাশি গ্রাহকদের খাবার পানিরও ব্যবস্থা করে। তবে যাঁরা দরিদ্র, যাঁরা সেচের পানি কিনতে পারেন না, তাঁরা খাবার পানিও কিনতে পারেন না। ফলে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মানুষ পানি পাচ্ছেন না।

ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার জন্য প্রাকৃতিক কারণ যেমন রয়েছে, তেমনি অব্যবস্থাপনাও রয়েছে বলে মনে করেন ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন, নগর উন্নয়ন ও দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির পরিচালক মো. লিয়াকত আলী। তিনি বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে যাঁরা পানি দেন, তাঁরা অরাজকতা তৈরি করেছেন। টাকা নিয়েও পানি দেন না। সেখানকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের কোণঠাসা করে রেখেছেন তাঁরা। এই জায়গায় কাজ করতে হবে। বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষিকে বাদ দেওয়া যাবে না, তবে ধরনে পরিবর্তন আনতে হবে বলেও মনে করেন লিয়াকত আলী। তিনি বলেন, না হলে খাদ্যনিরাপত্তার সংকট তৈরি হবে।

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন বলেন, ভূ–উপরিভাগের পানি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাত কমে গেছে। তারপরও যেটুকু হয়, তা ধরে রাখা হচ্ছে না। এদিকে নজর দিতে হবে।

“ভবিষ্যতের পানি সুরক্ষা: বরেন্দ্র অঞ্চলের সহনশীলতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা। ১৮ মার্চ রাজধানীর একটি হোটেলে প্রথম আলো, ব্র্যাক ও ওয়াটারএইড এই বৈঠকের আয়োজন করে
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ বলেন, কৃষিকাজের জন্য এই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি পানি উত্তোলন করা হচ্ছে, যার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা এ খান বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে খাওয়ার পানির তীব্র সংকট। এ অবস্থায় খাওয়ার পানিকে প্রাধান্য দিতে হবে, তারপর চাষাবাদ। এই অঞ্চলের চাষাবাদ চর্চার মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে। চাষাবাদ করতে গিয়ে পানির বড় একটি অংশের অপচয় হয়। এভাবে চলতে থাকলে একসময় খাওয়ার পানি পাওয়া যাবে না।

বরেন্দ্র অঞ্চলে ১৫ হাজারের বেশি গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে উল্লেখ করে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক নেহরীন মাজেদ বলেন, সেখানে পানিসংকটের প্রধান ভুক্তভোগী নারী ও শিশু। স্বাস্থ্য দুর্যোগে রয়েছে তারা। এই কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও যাঁরা টিকে আছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর কথা বলেন তিনি। অধ্যাপক নেহরীন বলেন, সেখানে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার প্রযুক্তি জনপ্রিয় হচ্ছে না।

বেসরকারি সংস্থা ডিএএসসিওএইচের পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, বরেন্দ্র এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পানিসংকট যেখানে, সেসব এলাকায় প্রায় এক লাখ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বাস করেন। যাঁরা সরাসরি কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। সেখানে নারীরা মাঠে কাজ করেন। পানি আনতে গেলে তাঁরা কাজ করতে পারেন না। ফলে তাঁরা দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হচ্ছেন।

ব্র্যাকের আইডিপি অ্যান্ড ওয়াশের পরিচালক হোসেন ইশরাত আদিব বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে যতটুকু পানি আছে, সেটিকে সবার জন্য নিশ্চিত করতে হবে।

গোলটেবিল বৈঠকের সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী। এ সময় বরেন্দ্র অঞ্চলের পানির সংকট নিয়ে একটি তথ্যচিত্রও তুলে ধরা হয়।