নিলামে উঠছে ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের স্পেকট্রাম, সেবার মান কতটা বাড়বে

মোবাইল নেটওয়ার্ক–বিভ্রাটএআই দিয়ে তৈরি প্রতীকী ছবি

দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবার মান নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগের শেষ নেই। গত মাসে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) গণশুনানিতে গ্রাহকদের কাছ থেকে দেড় হাজারের বেশি অভিযোগ জমা পড়েছিল। গ্রাহকেরা অপারেটরদের নানা অনিয়ম, অতিরিক্ত চার্জ ও নেটওয়ার্ক সমস্যাসহ বিভিন্ন ভোগান্তির কথা সেখানে তুলে ধরেন।

সেবার মানের পরিস্থিতি যখন এই, সে সময়েই টেলিযোগাযোগ সেবায় ‘গোল্ডেন স্পেকট্রাম’ হিসেবে পরিচিত ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের স্পেকট্রাম নিলামের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। আগামী ১৪ জানুয়ারি এই নিলাম অনুষ্ঠিত হবে।

একে ‘সুখবর’ বলছেন প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি–বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তিনি ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড দেশের একটি অত্যন্ত কৌশলগত সম্পদ। দীর্ঘদিন ধরে নানা জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতার কারণে অন্তত ১১ হাজার কোটি টাকার এই ফ্রিকোয়েন্সি সম্পদ ব্যবহারের বাইরে ছিল। এসব বাধা দূর করতে বিটিআরসি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ ও অর্থ মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ করেছে।’

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব আরও লেখেন, ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে ফোর–জি ও ফাইভ–জি নেটওয়ার্কের কাভারেজ বাড়ানো, শহর ও গ্রামে নেটওয়ার্ক বিস্তার এবং ইনডোর সংযোগ উন্নয়নে এই ব্যান্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কারণ, কমসংখ্যক টাওয়ার ব্যবহার করেই এই তরঙ্গ বিস্তৃত এলাকায় উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করতে সক্ষম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের তরঙ্গের বিশেষত্ব হলো, এটি দেয়াল ভেদ করে ঘরের মধ্যে সিগন্যাল পৌঁছাতে ভূমিকা রাখে এবং এর সাহায্যে কমসংখ্যক টাওয়ার স্থাপন করেই গ্রামাঞ্চল ও মহাসড়ক–সংলগ্ন অঞ্চলে বিস্তৃত কাভারেজ দেওয়া সম্ভব।

৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের সুবিধা কী

মোবাইল অপারেটরদের বৈশ্বিক সংগঠন জিএসএমএর তথ্য বলছে, স্পেকট্রাম হলো তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের বিভিন্ন অংশ, যা দিয়ে মোবাইলে ভয়েস কল, ইন্টারনেট ও অন্যান্য বেতার–সংযোগ পরিচালিত হয়। এর প্রতিটি ব্যান্ডের আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

বিস্তৃত এলাকায় উচ্চতর নেটওয়ার্ক কাভারেজের জন্য ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের তরঙ্গ ব্যবহার করা হয়। টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই তরঙ্গের বিশেষত্ব হলো, এটি দেয়াল ভেদ করে ঘরের মধ্যে সিগন্যাল পৌঁছাতে ভূমিকা রাখে এবং এর সাহায্যে কমসংখ্যক টাওয়ার স্থাপন করেই গ্রামাঞ্চল ও মহাসড়ক–সংলগ্ন অঞ্চলে বিস্তৃত কাভারেজ দেওয়া সম্ভব।

জিএসএমএর ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, নিম্ন ফ্রিকোয়েন্সির কারণে ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড একক সেলের আওতায় বৃহৎ এলাকা কাভার করতে পারে। গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেবা বিস্তারে এটি অত্যাবশ্যক। এই ব্যান্ড দিয়ে উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডের তুলনায় কমসংখ্যক বেজ স্টেশন ব্যবহার করে বড় এলাকায় সেবা দেওয়া যায়। ফলে অপারেটরের স্থাপন ব্যয় কমে এবং গ্রাহকেরা অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্মত ব্রডব্যান্ড সেবা পান।

জানতে চাইলে টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির প্রথম আলোকে বলেন, নিম্ন ফ্রিকোয়েন্সির অন্যতম সুবিধা হলো বিল্ডিং পেনিট্রেশন অর্থাৎ ভবনের দেয়াল ভেদ করে সিগন্যাল গভীরে পৌঁছাতে পারে। বিশেষ করে ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরাঞ্চলে এই ব্যান্ডের সক্ষমতা ব্যবহারকারীদের ইনডোর কাভারেজ, ভয়েস কল ও ইন্টারনেটের অভিজ্ঞতা আরও উন্নত করবে।

প্রত্যন্ত এলাকায় নেটওয়ার্ক কাভারেজ বাড়ানোর জন্য একে ‘গেম চেঞ্জার’ অভিহিত করে সুমন আহমেদ বলেন, ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা কাভার করতে পারে। অর্থাৎ একটি বিটিএস দিয়ে ৫ থেকে ১০ গুণ বেশি এলাকা কাভার করা সম্ভব হবে। গ্রাম, চর, পাহাড়ি এলাকা ও সীমান্ত অঞ্চল—সব জায়গায় নেটওয়ার্ক পৌঁছে দিতে এটি সবচেয়ে সাশ্রয়ী বিকল্প।

৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা কাভার করতে পারে। গ্রাম, চর, পাহাড়ি এলাকা ও সীমান্ত অঞ্চল—সব জায়গায় নেটওয়ার্ক পৌঁছে দিতে এটি সবচেয়ে সাশ্রয়ী বিকল্প।
সুমন আহমেদ, টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ

তাহলে এত দিন ব্যবহার হয়নি কেন

বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে, শুরুতে বিটিআরসি এই ব্যান্ডের গুরুত্ব পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেনি। মোবাইল অপারেটরদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই স্পেকট্রাম ২০০৭ সালে বরাদ্দ দেওয়া হয় অলওয়েজ অন নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ লিমিটেড (এওএনবি) নামের একটি ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানিকে (আইএসপি)। তবে বরাদ্দপত্রে শর্ত ছিল, এই ব্যান্ড কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলে বরাদ্দ বাতিল করা হবে।

পরে গুরুত্ব অনুধাবন করে বরাদ্দটি বাতিল করে বিটিআরসি। তখন ওই আইএসপি আদালতে যায় এবং আইনি জটিলতার কারণে দীর্ঘদিন নিলামের প্রক্রিয়া আটকে ছিল। গত ২৩ নভেম্বর বিটিআরসি আগামী বছরের ১৪ জানুয়ারি নিলাম আয়োজনের ঘোষণা দেয়।

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বিটিআরসির প্রধান কার্যালয়
ছবি: বিটিআরসির ওয়েবসাইট থেকে

বিটিআরসির কর্মকর্তারা বলছেন, ৪৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গের মধ্যে আইনি জটিলতা রয়েছে ২০ মেগাহার্টজ নিয়ে। তাই ২৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে নিলামের আগে আদালত থেকে বিচারাধীন বিষয়টি নিষ্পত্তি হলে সম্পূর্ণ ৪৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ বরাদ্দের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

দাম নিয়ে অপারেটরদের অসন্তোষ

বিটিআরসির নথি থেকে জানা গেছে, ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের ভিত্তিমূল্য ধরা হয়েছে প্রতি মেগাহার্টজ ২৩৭ কোটি টাকা। আর মেয়াদ ১৫ বছর। নিলামে অংশ নিতে অপারেটরদের ১৫ লাখ টাকা অফেরতযোগ্য আবেদন ফি ও ১০ কোটি টাকার বিড ডিপোজিট জমা দিতে হবে। ২৫ মেগাহার্টজ ব্যান্ড পাঁচটি ব্লকে নিলামে তোলা হবে।

তবে এই তরঙ্গের দাম নিয়ে সন্তুষ্ট নয় দেশের বেসরকারি তিন মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক। তারা বলছে, নির্ধারিত বেজ প্রাইস আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় বেশি। ফলে এত উচ্চ মূল্যে ব্যান্ড তুললে বিনিয়োগের চাপ বাড়বে। নিলামে অংশগ্রহণ নিয়ে অনিচ্ছার কথাও জানিয়েছে কেউ কেউ।

৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের ভিত্তিমূল্য ধরা হয়েছে প্রতি মেগাহার্টজ ২৩৭ কোটি টাকা। আর মেয়াদ ১৫ বছর। নিলামে অংশ নিতে অপারেটরদের ১৫ লাখ টাকা অফেরতযোগ্য আবেদন ফি ও ১০ কোটি টাকার বিড ডিপোজিট জমা দিতে হবে।

গত মাসেই দাম কমাতে যৌথভাবে বিটিআরসিতে চিঠি দেয় তিন অপারেটর। ওই চিঠিতে তারা বলেছিল, ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের মূল্যায়ন ৯০০ ও ১৮০০ ব্যান্ডের সঙ্গে মিলিয়ে করা হয়েছে। কিন্তু এই ব্যান্ডগুলোর ব্যবসায়িক পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে ভিন্ন। ৭০০ মেগাহার্টজ স্পেকট্রামে বিনিয়োগের প্রত্যাশিত আয় ৯০০ বা ১৮০০–এর তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।

৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের নেটওয়ার্ক অবকাঠামো তৈরির জন্য নতুন বিনিয়োগ এবং নেটওয়ার্ক স্থাপনার জন্য খরচও বৃদ্ধির বিষয়টি উল্লেখ করে চিঠিতে আরও বলা হয়, নিলামে অংশগ্রহণের জন্য অপারেটরগুলোর বিনিয়োগকারীদেরকে উৎসাহিত করা কঠিন হবে। বিটিআরসি ও সরকারের কাছে দাম পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধও করা হয় ওই চিঠিতে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার তানভীর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা গাইডলাইনটা পেয়েছি। এটা পর্যালোচনা করা হচ্ছে।’ বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডকে জাতীয় পর্যায়ে নেটওয়ার্ক কাভারেজের মূল “ডিজিটাল ডিভিডেন্ড” ব্যান্ড হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশেও এ ব্যান্ডের সর্বোচ্চ সুফল পেতে হলে এর মূল্য আরও যুক্তিসংগত করতে হবে। লাইসেন্স পাওয়া সব অপারেটরের মধ্যে ন্যায্যভাবে বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।’

অপারেটররা চাইলেও দাম পুনর্বিবেচনার বিষয়টি এখনো বিটিআরসির বিবেচনায় নেই। কমিশনের কর্মকর্তারা বলেন, তরঙ্গের দাম সরকারের অনুমোদন নিয়েই নির্ধারণ করা হয়েছে।