ভাষাসংগ্রামী এবং ভাষা আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিষয়ে গবেষক আহমদ রফিকের ৯৭তম জন্মদিন আজ। তাঁর এমন জন্মদিন আগে কখনো আসেনি।
গত ২৯ আগস্ট তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ভাঙা গলায় আহমদ রফিক বলেন, ‘দু-এক দিন পর আবার এসো। অনেক কথা আছে।’ বুঝতে পারছিলাম, এই ‘দু-এক দিন’ আর না–ও আসতে পারে। তাই বললাম, ‘আজই বলেন, স্যার। আমার সময় আছে।’ তিনি ফিসফিসিয়ে এবার বললেন, ‘আজ তো কথা বলতে পারছি না।’
এখন ভাবছি কী বলতে চেয়েছিলেন তিনি? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন তাঁর শেষ জন্মদিনের আগে বলেছিলেন, ‘আমার এ জন্মদিন-মাঝে আমি হারা/ আমি চাহি বন্ধুজন যারা/ তাহাদের হাতের পরশে/ মর্ত্যের অন্তিম প্রীতিরসে/ নিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ,/ নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ।’
তেমন কিছুই হয়তো বলতে চেয়েছিলেন আহমদ রফিক। কারণ, নিঃসঙ্গতা ও অনেকের অবহেলা সত্ত্বেও জীবন ও মানুষের প্রতি কখনো কোনো অভিযোগ ছিল না তাঁর। চলনশক্তিহীন অবস্থাতেও অপেক্ষা করেছেন, কেউ পাশে বসুক, কথা বলুক। আলোচনা উসকে দিতেন ইতিহাস, সাহিত্য, রাজনীতি বিষয়ে। কিন্তু তাঁর অপেক্ষা কেবল দীর্ঘায়িতই হয়েছে। পরিবার ও স্বজনহীন মানুষটি সমমনা মানুষদের কাছে উপেক্ষিত হয়েছেন। বছর তিনেক থেকে তাঁর নিঃসঙ্গতা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। মাস ছয়েক আগেও নিকটজনদের অনুরোধ করেছেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে নিয়ে একটা ফাউন্ডেশন করার। এত বড় সুরস্রষ্টার বাড়ি-স্মৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে, মানতে পারেননি। তাঁকে নিয়ে বলার সময় অশ্রুসজল হয়েছেন বারবার।
আহমদ রফিক সার্বক্ষণিক লেখক। কিন্তু ২০২২ সাল থেকে তিনি প্রায় চলনশক্তি ও দৃষ্টিশক্তিহীন। স্মৃতিশক্তি প্রখর ছিল বলে বলতে পারতেন অনর্গল। সময় কাটে না বলে বছরখানেক থেকে তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গীর সহযোগিতায় একটা উপন্যাস লেখায় হাত দিয়েছিলেন। শেষও করেছেন। কিন্তু সম্পাদনা করবেন কীভাবে? আশ্বস্ত করেছি দায়িত্ব নেওয়ার। কথাও দিয়েছিলেন, দেবেন। কিন্তু দেবেন-দিচ্ছি করেও দিতে পারলেন না।
সাধারণত সপ্তাহে একবার তাঁর কাছে যাই। জন্মদিনের আগে আগে যাওয়াটা আবশ্যক মনে করতাম। আগাম অভিনন্দন জানাতাম। গত ১৭ আগস্ট দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে তাঁকে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ল্যাবএইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁর চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়। এরপর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে ২৪ আগস্ট তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয়। ছয় দিনের মাথায় অবস্থার অবনতি হলে আবার তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তিনি ৫ সেপ্টেম্বর ছাড়া পান। দুই দিন পর অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে আবারও হাসপাতালে নেওয়া হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার ল্যাবএইড হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। এই প্রায় তিন সপ্তাহে তিনবার তাঁকে হাসপাতালে আনা–নেওয়া ও চিকিৎসার পুরো দায়িত্ব পালন করেছে ল্যাবএইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
চিকিৎসার ঘাটতি না পড়লেও ১০ দিন হলো সংজ্ঞাহীন অবস্থায় চিকিৎসাধীন। তিনি নিঃসন্তান। তবে একজন মানুষ কতটা স্বজনহীন হতে পারেন, হতে পারেন কতটা নিঃসঙ্গ, তা তাঁকে না দেখলে উপলব্ধি করা যাবে না। এই জুলাই মাসের আগেও তিনি কেবল সঙ্গ চেয়েছেন, কথা বলতে চেয়েছেন। কখনো যত্ন বা নিজস্ব চাহিদার জন্য উদ্গ্রীব ছিলেন না। চেয়েছেন কেউ একটু কথা বলুক, সময় দিক। এখন তিনি সংজ্ঞাহীন অবস্থায় এসবের ঊর্ধ্বে।
২০২১ সালে একবার পড়ে গিয়ে আহমদ রফিকের ঊরুসন্ধির হাড় ভেঙে গিয়েছিল। অস্ত্রোপচারের টেবিলে নেওয়ার আগমুহূর্তে সম্মতিপত্রে স্বজনের স্বাক্ষরের দরকার পড়েছিল। রক্ত-সম্পর্কীয় কেউ ছিল না বলে আমরা দু-তিনজন তরুণ সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করি। দৃষ্টিশক্তি হারানোর আগপর্যন্ত নানাজনকে তিনি নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন, দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে দিয়েছেন, কিন্তু এখন তিনি একাকী।
আগে সপ্তাহখানেক কথা না হলেই জরুরি আলাপ আছে বলে ফোন করতেন। কখনো সময়মতো যেতে পেরেছি, কখনো পারিনি। না যেতে পারলে জানাতে হতো। না হলে নির্দিষ্ট সময়ের আগে থেকেই অপেক্ষা করতে থাকতেন। খুব যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সব সময় তলব করতেন, এমন নয়। আসলে সঙ্গই চাইতেন। অনর্গল বলে চলতেন। মুগ্ধ হয়ে শুনতাম।
গত জুলাই মাস থেকেই কিছুটা বিরতিতে হাসপাতালেই সময় কাটছে এই ভাষাসংগ্রামীর। শারীরিক জটিলতার প্রায় সবটাই বয়সজনিত। মাত্র দুই বছর আগেও গর্ব করে বলেছেন, বয়স নব্বই পার হলেও তাঁর স্মৃতিশক্তি এখনো তরুণদের মতো। এবার হাসপাতাল থেকে ফিরে তিনি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি; বরং আবারও ফিরতে হয়েছে হাসপাতালে। সেখানে শুয়ে আছেন সংজ্ঞাহীন। হয়তো মনে মনে আওড়াচ্ছেন তাঁর প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথের কবিতা: ‘সমুখে শান্তিপারাবার,/ ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।...অসীমের পথে জ্বলিবে জ্যোতি/ ধ্রুবতারকার।/ হয় যেন মর্ত্যের বন্ধন ক্ষয়,/ বিরাট বিশ্ব বাহু মেলি লয়,/ পায় অন্তরে নির্ভয় পরিচয়/ মহা-অজানার।’
ইসমাইল সাদী: শিক্ষক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়