এত মূল্যবৃদ্ধির ভার সাধারণ মানুষ বইতে পারবে না: ম তামিম

জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা, অকটেনের দাম লিটারে ৪৬ টাকা আর পেট্রলের দাম লিটারে ৪৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এখন এক লিটার ডিজেল ও কেরোসিন কিনতে ১১৪ টাকা লাগবে। এক লিটার অকটেনের জন্য দিতে হবে ১৩৫ টাকা। আর প্রতি লিটার পেট্রলের দাম হবে ১৩০ টাকা। এক লাফে এই মূল্যবৃদ্ধি এবং এর প্রভাব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম।

অধ্যাপক ম তামিম
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমেছে, তাহলে আমাদের দেশে কেন তা বাড়ল?

ম তামিম: তেলের দাম ওঠানামা করে। এই মুহূর্তে আমরা যে প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি এবং সামনে যে প্রাক্কলন আছে, তাতে বলা হচ্ছে, তেলের দাম এ বছরের শেষ নাগাদ ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলারে দাঁড়াবে। অর্থাৎ কমে আসছে। এখন দেশে মূল্যবৃদ্ধির একটি কারণ হতে পারে অতীতে যে লোকসান করেছে, সামনে আর কোনো লোকসানে যেতে চায় না। বরং লোকসান কাটিয়ে তারা কিছুটা লাভে যেতে চাচ্ছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লোকসান হয়েছে, কিন্তু অতি উচ্চমূল্য পরিশোধ করে এখন যখন দাম কমে আসছে, তখন এত মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা আমি অন্তত বুঝতে পারি না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: তেলের দাম বাড়তে পারে, এমন একটি ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু এক লাফে এত বাড়ানোর কারণ কী বলে মনে করেন?

ম তামিম: সরকারের যৌক্তিকতার কথা তো বলেছি, অনেক বেশি ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। কিন্তু এখন তো শূন্য ভর্তুকির পর্যায়ে দাম নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অতএব ভর্তুকি তো দেওয়া হবেই না, বরং আরও লাভ হতে পারে। তাহলে কি সরকার নীতিগতভাবে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দেওয়া থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে? সেই সিদ্ধান্ত সরকার নিতেই পারে। আমিও ব্যক্তিগতভাবে ভর্তুকির পক্ষে নই। বিশেষ করে সর্বজনীন ভর্তুকি যেটা বলি, সেটির পক্ষে আমি নই। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ভর্তুকি থাকতে পারে। কিন্তু সেই ম্যাকানিজম আমাদের একেবারে নেই। নীতিগতভাবে যদি সরকার ভর্তুকির বিষয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তাহলে কিন্তু সামনে বিদ্যুতের দাম বাড়বে। ভর্তুকির ওপর ভিত্তি করেই কিন্তু আমাদের অর্থনীতির কাঠামোটি তৈরি। সেখান থেকে আমরা যদি এখন বেরিয়ে আসতে চাই, তাহলে হঠাৎ করে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা কি আমাদের অর্থনীতি সইতে পারবে? এই ধাক্কা কতটুকু সামাল দিতে পারব, সেটি অর্থনীতিবিদেরা ভালো বলতে পারবেন। তবে সাধারণ মানুষ হিসেবে এটুকু বলতে পারি যে সবার মধ্যে প্রচণ্ড আতঙ্ক ও আশঙ্কা বিরাজ করছে, যে কী হবে? দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে? কোন জিনিসের দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে? আমি কী চলতে পারব কি না। কারণ, ইতিমধ্যে মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক কিছু ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। অনেকে কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছে। কৃচ্ছ্রসাধন করছে। আমরা বড় আকারে লোডশেডিং দেখতে পাচ্ছি। অর্থাৎ আমরা খুবই কঠিন একটি সময় পারছি। এই কঠিন সময় কতখানি কঠিন হবে, সেটি মানুষে জন্য কতখানি অসহ্য হয়ে যাবে বা বহন করার ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে কি না, সময়ের সঙ্গে বা সামনের এক-দেড় মাসের মধ্যে বুঝতে পারব, যে এর প্রতিঘাত কী হচ্ছে অর্থনীতিতে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনি বলছিলেন বিপিসি লাভ-লোকসান সমন্বয় করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই মুহূর্তে কেন সেটি করতে হচ্ছে?

ম তামিম: ভর্তুকির সিদ্ধান্ত কিন্তু সরকারি সিদ্ধান্ত। অর্থনীতিতে সব সরকারই ভর্তুকি দিয়ে গেছে। জ্বালানি খাতেও দিয়েছে বিনিয়োগ হিসেবে। যেন জ্বালানিসংক্রান্ত বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, অর্জন যেন সচল থাকে। যদিও বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি অর্থাৎ পশ্চিমা অর্থনীতি প্রথম থেকেই ভর্তুকিবিরোধী। আজকে কিন্তু সারা পশ্চিমা বিশ্বে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে। সেই প্রেক্ষাপটে আজকে বাংলাদেশে ভর্তুকি উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এটি আমার কাছে খুব অবাক লাগছে। বর্তমানে চারদিকে যে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে, সেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, টার্গেটেড ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান এই কঠিন পরিস্থিতিতে উন্নত বিশ্ব তার সাধারণ জনগণকে সাহায্য করা জন্য ভর্তুকি দিচ্ছে। আমাদের সব সরকারও সাধারণ জনগণের কথা বিবেচনা করে সব সময় ভর্তুকি দিয়ে গেছে। ভর্তুকি দেওয়ার বিষয়ে যখন মানা করা হয়েছে, তখন সেটিকে প্রতিরোধ করেই সরকার ভর্তুকি দিয়েছে। এখন বুঝতে পারছি না কী কারণে এই ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে এত উচ্চমূল্য ধার্য করা হয়েছে?

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনি বলছেন এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাবে, তো এই অবস্থাটি আমাদের অর্থনীতি কীভাবে সামাল দেবে?

ম তামিম: আমি তো অর্থনীতিবিদ না। তবে সাধারণ মানুষ হিসেবে বলতে পারি, সাধারণ মানুষের ধাক্কাটি হবে মূল্যস্ফীতির। যাতায়াত খরচ বাড়বে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়বে, বাড়িভাড়া বাড়বে অথচ আমাদের কিন্তু বেতন বৃদ্ধি হচ্ছে না। সরকারি কর্মচারীদের যে ৫ শতাংশ বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেটিও মূল্যস্ফীতির চেয়ে অনেক কম। ধারণা করা হচ্ছে, এই মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। তখন মানুষের জন্য জীবনযাত্রা আসলে কঠিন হয়ে যাবে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: দাম না বাড়িয়ে সরকার বিকল্প কিছু করতে পারত বলে কি আপনি মনে করেন?

ম তামিম: সরকার যদি নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে যে তারা ভর্তুকি দেবে না, তাহলে আমি বলব খুব বাজে সময়ে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত জ্বালানির দাম কম থাকা অবস্থায় নেওয়া ভালো ছিল। সবিনয়ে সরকারের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, এই মূল্যবৃদ্ধি যেন পুনর্বিবেচনা করা হয়। কারণ, এত উচ্চমূল্য বৃদ্ধির ভার সাধারণ মানুষ বইতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।