ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে রিভিউ ৬ বিচারপতির বেঞ্চ শুনতে পারেন কি না, সিদ্ধান্ত ২৩ নভেম্বর
বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা বহাল রেখে রায় দিয়েছিলেন আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। এই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন (রিভিউ) আজ বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ছয় সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য ওঠে।
সাত বিচারপতির দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা পুনর্বিবেচনার আবেদন ছয় বিচারপতির বেঞ্চ শুনতে পারে কি না, শুনানিতে এমন প্রশ্নে ওঠে। এই প্রশ্নে জ্যেষ্ঠ আটজন আইনজীবীর মতামত শোনেন আপিল বিভাগ। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মত হচ্ছে, ছয় সদস্যের বেঞ্চ রিভিউ শুনতে পারেন। পরে আপিল বিভাগ এ বিষয়ে আগামী বৃহস্পতিবার আদেশের জন্য দিন রেখেছেন। একই সঙ্গে পুনর্বিবেচনার আবেদনের শুনানি এক সপ্তাহের জন্য মুলতবি করা হয়েছে।
বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। এর বৈধতা নিয়ে করা এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্টের তিনজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এস কে সিনহা) নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিতে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই ওই আপিল খারিজ করে রায় দেন। এই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর আপিল বিভাগে আবেদন (রিভউ) করে রাষ্ট্রপক্ষ, যা গত বছরের আগস্টে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে ওঠে। চেম্বার আদালত আবেদনটি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান।
এরপর বেশ কয়েকবার রিভিউ আবেদনটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় ওঠে। সর্বশেষ ৯ নভেম্বর রিট আবেদনকারীপক্ষের সময়ের আরজির পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ ১৬ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) শুনানির জন্য দিন রাখেন। আগের ধারাবাহিকতায় আপিল বিভাগের আজকের কার্যতালিকায় রিভিউ আবেদনটি ১৪ নম্বর ক্রমিকে ছিল।
সকাল সোয়া নয়টার দিকে এজলাসে আসেন প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের অপর পাঁচ বিচারপতি। বিচারপতিদের আসন গ্রহণের পর রিভিউ আবেদনের বিষয়টি তুলে ধরেন রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী বলেন, এখন সংসদের অধিবেশন নেই, তাই শুনানি জরুরি নয়। সাত বিচারপতির বেঞ্চ রায় দিয়েছেন। বেঞ্চে এখন ছয়জন বিচারপতি আছেন। প্রথা অনুসারে রিভিউ সমসংখ্যক বিচারপতি বা তার চেয়ে বেশিসংখ্যক বিচারপতির বেঞ্চে শুনানি হয়ে থাকে। আপিল বিভাগের বিধিমালায় ‘সেম বেঞ্চ’ বলা আছে, অর্থাৎ সমসংখ্যক বিচারপতি। ধারণা করা হচ্ছে, সাতজন বিচারপতি নেই, তাই শুনানি হবে না। এক সপ্তাহ সময়ের আরজি জানান তিনি।
মনজিল মোরসেদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ধারণা করবেন কেন? আগে ঠিক করি ফুল বেঞ্চ (ছয় সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ) শুনতে পারি কি না? আদালতে উপস্থিত জ্যেষ্ঠ কয়েকজন আইনজীবীর নাম উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, এ বিষয়ে অপিনিয়ন (মতামত) নেব।
পরে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আজমালুল হোসেন কেসি, প্রবীর নিয়োগী, কামরুল হক সিদ্দিকী, মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ, সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তানজিব উল আলম আদালতে মতামত তুলে ধরেন।
জ্যেষ্ঠ এই আট আইনজীবীর মধ্যে সাতজনের মতামতের মূল কথা হচ্ছে, আপিল বিভাগে এখন ছয়জন বিচারপতি আছেন, তাঁদের সমন্বয়েই ফুল বেঞ্চ। বিচারপতির সংখ্যা কোনো বিষয় নয়। কেননা, বিধিতে বেঞ্চ উল্লেখ আছে, বিচারপতির সংখ্যা উল্লেখ নেই। তাই রিভিউ শুনতে বাধা নেই।
এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কামরুল হক সিদ্দিকী বলেন, আপিল বিভাগের পুনর্বিবেচনার ক্ষমতা সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদে দেওয়া আছে। এতে বিচারপতির সংখ্যা উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে ১০৫ অনুচ্ছেদে নিষেধাজ্ঞা ও বিধান নেই। আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট বিধিতেও বিচারপতির সংখ্যা উল্লেখ নেই। এটি নজির হয়ে থাকবে, যা দীর্ঘদিন ধরে চলবে। তাই নতুন করে বিতর্ক আহ্বান করা সমীচীন নয়। এ ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা যেতে পারে।
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এস কে সিনহা) নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিতে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল ২০১৭ সালের ৩ জুলাই খারিজ করে রায় ঘোষণা করেন। পূর্ণাঙ্গ রায় ২০১৭ সালের ১ আগস্ট প্রকাশিত হয়। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তাঁর লেখা রায়ে গণতন্ত্র, রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, সুশাসন, দুর্নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দেন।
পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও সরকারপন্থী আইনজীবীরা। কেউ কেউ প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিও তোলেন। অন্যদিকে এই রায়কে স্বাগত জানায় বিএনপি। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পর ছুটি নিয়ে বিদেশে যান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। ছুটি শেষে কানাডা যাওয়ার পথে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনে রাষ্ট্রপতি বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন তিনি। ২০১৭ সালের নভেম্বরে পদত্যাগপত্র বঙ্গভবনে এসে পৌঁছায়। পরে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বিচারপতি সিনহার পদত্যাগপত্রটি গ্রহণ করেন।