গন্ধরাজের গন্ধে খুঁজে ফিরি হারিয়ে যাওয়া বাবাকে

জুলাই মাসের কোনো এক ঝুম বর্ষায় জন্ম হয় আমার। পরিবারের সবার প্রত্যাশা ছিল, কন্যাসন্তানের পর এবার নিশ্চয়ই পুত্রসন্তান হবে ঘর আলো করে। আমার মা কেন জানি অনেকটাই নিশ্চিন্ত ছিলেন, তিনি পুত্রসন্তানের মা হতে চলেছেন। হয়তো বড় সন্তান কন্যা হওয়ার পর পুত্রসন্তানই ছিল তাঁর জন্য সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত আর মর্যাদার। কিন্তু ঘর আলো করে সংসারের বাতি জ্বলল না। এবারও কন্যাসন্তানের মুখ দেখলেন আমার মা-বাবা।

একবুক নিরাশা নিয়েও পরম মমতায় আমাকে বুকে তুলে নিলেন মা। আমি নিশ্চিত, অস্ফুট কান্না হয়তোবা কণ্ঠ রোধ করেছিল তাঁর। নিঃশব্দ কষ্ট হৃদয় বিদীর্ণ করে হয়তো বলেছিল, ‘আবার একটা মেয়ে এল নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে কষ্ট করতে!’

কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে খুশির জোয়ারে ভেসেছিলেন আমার বাবা। নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে বলে উঠেছিলেন, ‘আজ থেকে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। আজ আমার ঘর আলো করল আমার দুই কন্যা।’

এই সাহস আর শক্তি তিনি কোথায় পেয়েছিলেন, আমি জানি না। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, তাঁর দুই কন্যাকে নিয়েই একটি জীবন পার করে দেবেন। তাই শত সামাজিক চাপের মধ্যেও কখনো পুত্রসন্তান লাভের চেষ্টা করেননি। তখনকার সময় বিবেচনায় তাঁর এই সিদ্ধান্ত ছিল বিরল, সাহসী আর বলিষ্ঠ এক সিদ্ধান্ত। দুই মেয়ের প্রতি এত আস্থা কোথায়, কীভাবে পেলেন তিনি, তা আজও খুঁজে ফিরি আমি।

আমার জীবনের যা কিছু অর্জন, তার প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে আছেন আমার বাবা। বাকিটা মায়ের অবদান। মা আমাদের দুই বোনের সামনে জীবনের প্রায় প্রতিটি সম্ভাবনার দ্বার অবমুক্ত করেছিলেন। আর বাবা ছিলেন সেই মুক্ত পথে আমাদের এগিয়ে নেওয়ার কান্ডারি। তিনি ছিলেন আমার মায়ের বিশ্বস্ত সহযাত্রী। আমাদের জীবনের এই দুই পথপ্রদর্শকের চমৎকার রসায়ন আমাদের জীবন সম্পর্কে ভাবতে শিখিয়েছে, সামনে এগিয়ে যাওয়ার রসদ জুগিয়েছে, জুগিয়েছে ভালোবাসতে আর নিজেদের ভালো রাখতে।

দুই বছর হলো বাবা বেঁচে নেই। কিন্তু তিনি মিশে আছেন আমাদের সমগ্র অস্তিত্বজুড়ে। তিনি আছেন আমার চিন্তাচেতনায়, আমার আবেগে-আদর্শে, আমার ভালো লাগা-ভালোবাসায়। তিনি বলতেন, ‘মা রে, যা কিছু দীপ্যমান, তা আলো ছড়াবেই। তাই আলো ছড়ানোর জন্য বাড়তি কোনো আয়োজন কখনো করতে যেয়ো না।’

লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে যাওয়া বাবাকে আমি আজও খুঁজে ফিরি তীব্র জ্বরের অনুভূতির মধ্যে ফলের জুস হাতে, পাশে বসে থাকতে। আজও কল্পনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হল গেটে আমি তাঁকে খুঁজে পাই আমার চলে যাওয়া পথের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে। হয়তো তখন তাঁর চোখজুড়ে নেমেছে শ্রাবণের অঝোর ধারা। তাঁকে খুঁজে পাই উদ্বিগ্ন মুখে এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রের গেটে কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের লাইনে।

আমি বিশ্বাস করি, মর্ত্যের পৃথিবীর বাইরে যে পৃথিবী আছে, সেখানেও তিনি ব্যস্ত আছেন আমাদের এসব উদ্বিগ্নতা ঘিরেই। সেই অনুভূতি থেকেই আজও দেশের বাইরে পৌঁছেই মনে মনে সবার আগে খবরটা দিই বাবাকে। যেকোনো লেখা পত্রিকায় ছাপানো হলে সবার আগে মনে মনে পড়ে শোনাই বাবাকেই। কারণ, তিনিই ছিলেন আমার লেখার সবচেয়ে বড় ভক্ত, সমালোচক ও উৎসাহদাতা।

আমার বাবা যখন মৃত্যুশয্যায়, একবার জানতে চেয়েছিলাম, আমার জন্য তাঁর আশীর্বাদ কী? তখন তিনি অনেকটাই কোমায় ছিলেন। ক্যানসার তত দিনে তাঁকে প্রায় পুরোটাই গ্রাস করে নিয়েছে। সোডিয়াম আর ইলেকট্রোলাইটের ঘাটতিতে প্রায় সারা দিন ঘোরের মধ্যে থাকতেন তিনি। তবু কী এক অদ্ভুত মায়ায় বাবা আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। আশীর্বাদ করেছিলেন, ‘তোমার সন্তানেরা যেন তোমার মতো হয়।’
তিনি কী বুঝে এই আশীর্বাদ করেছিলেন, আমি জানি না। তবে বাবার আশীর্বাদ আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি আশীর্বাদ।

আজও আমি প্রতিদিন বাবার গায়ের ঘ্রাণ পাই, তাঁর প্রিয় খাবারগুলো খেতে গিয়ে গলা আটকে আসে আমার। প্রচণ্ড শীতে তিনি যেভাবে আমার নরম-কোমল ছোট্ট হাতগুলো ঘষে গরম করে দিতেন, তেমনটা আজ আর কেউ করে না।
আজকাল প্রায়ই খুব আফসোস হয়, কখনো তোমাকে মন খুলে বলা হয়নি ‘আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি বাবা।’ আদর করে তোমার কপালে হয়তো কখনো চুমু খাওয়া হয়নি। কিন্তু খুব ভালোবাসি তোমাকে—এই সত্য অস্বীকার করা মানে যেন নিজ সত্তাকেই অস্বীকার করা।

বাবা, তোমার শেষশয্যাতেই আমার অন্তিমশয্যা পাতার সাধ হয়। তোমার কবরের পাশে থাকা সুগন্ধি গন্ধরাজরা টুপটাপ ঝরে পড়বে আমাদের ওপর আর আমরা বাবা-মেয়ে ভাগাভাগি করে নেব স্বর্গীয় সেই সুগন্ধ। কেমন হবে বলো তো?

নিশাত সুলতানা: লেখক ও উন্নয়নকর্মী