প্রতিবাদী সমাবেশ ছিল সংগীতশিল্পীদের। কিন্তু ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরের উন্মুক্ত মঞ্চ থেকে পুরো চত্বর পরিণত হলো সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবির গণবিক্ষোভে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে নিহত শিক্ষার্থী ও জনতার প্রতি শোক ও চলমান আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করতে আজ শনিবার বেলা তিনটায় রবীন্দ্রসরোবরে ছিল সংগীতশিল্পীদের প্রতিবাদী সমাবেশ। তবে বেলা একটা থেকেই সেখানে ধানমন্ডি এলাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ সমবেত হতে থাকেন। তাঁরা হাতে লেখা স্লোগান, প্ল্যাকার্ড প্রভৃতি ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বিক্ষোভ করতে থাকেন।
‘আমরা সবাই জনতা/ এক সাথে একতা’, লেগেছে রে লেগেছে/ রক্তে আগুন লেগেছে’, ‘রক্তের বন্যায়/ ভেসে যাবে অন্যায়’, ‘ভুয়া ভুয়া’—এমন বিভিন্ন স্লোগানে স্লোগানে তাঁরা রবীন্দ্রসরোবর সচকিত করে তোলেন।
বেলা আড়াইটার দিকে ব্যান্ডসংগীতশিল্পী মাকসুদ, হামিন আহমেদ, পার্থ বড়ুয়া, টিপু, সুরকার প্রিন্স মাহমুদ, শওকত আলী ইমনসহ শিল্পী নাসিম আলী খান, প্রবর রিপন, রুবাইসহ অনেকে রবীন্দ্রসরোবরে আসেন। তাঁরা নির্ধারিত সময়ের আগেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে মঞ্চ ছেড়ে চলে যান।
তবে মঞ্চ খালি থাকেনি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বিভিন্ন সংগঠন একের পর এক সামনে আসতে থাকে। তাদের মধ্যে ‘৯১ বন্ধু সংগঠন’ নামে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের সংগঠনের বন্ধুরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিতে থাকেন।
বক্তারা কোমলপ্রাণ শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের ন্যায্য আন্দোলন যেভাবে সরকার দমন করতে চেষ্টা করেছে, তার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানান। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নিরপেক্ষ তদন্ত করে তাদের কঠোর শাস্তি দাবি করেন। একই সঙ্গে তাঁরা বলেন, এই আন্দোলন এখন আর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নেই। সর্বস্তরের মানুষ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আলোচনার সুযোগ নেই। এই স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
’৯১ বন্ধু সংগঠন’-এর পক্ষে এখানে বক্তব্য দেন মাসুদ মনিরুল, তৌহিদ হোসেন মজুমদার, আইনজীবী মুনিরুজ্জামান, লায়লা জেনি, তাজউদ্দিন আহমদ, ইন্দ্রজিৎ দাস, মহিদুল ইসলাম প্রমুখ। প্রত্যেক বক্তার বক্তব্য শেষ হতেই জনতা করতালির সঙ্গে স্লোগান দিতে থাকে।
বেলা তিনটার দিকে রবীন্দ্রসরোবর চত্বরসহ সংলগ্ন ধানমন্ডি ৫, ৬ ও ৭ নম্বর সড়কের অংশবিশেষজুড়ে বিপুল জনসমাবেশ ঘটে। উন্মুক্ত মঞ্চ প্রকৃতপক্ষেই সবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে ওঠে।
বন্ধু সংগঠন বক্তব্য দেওয়ার পর এখানে ‘বেসরকারি চাকরিজীবী সমিতি’, ‘সানিডেল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল শিক্ষার্থীবৃন্দ’, ‘সচেতন নাগরিক সমাজ’সহ বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানার নিয়ে প্রতিবাদী ছাত্র-জনতা মঞ্চের সামনে এসে তাদের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ প্রকাশ করেন।
একপর্যায়ে বিকেল চারটার দিকে শিল্পী অর্ণবের সঙ্গে আরও বেশ কিছু সংগীতশিল্পী রবীন্দ্রসরোবরে আসন। কিন্তু পুরো চত্বর তখন বিক্ষোভে উত্তাল। তাঁরা আর সেই উন্মত্ত জনতার স্রোত ঠেলে মূল মঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছাতে চেষ্টা করেননি। চত্বরের বাইরে ফুটপাতের পাশে সারিবদ্ধভাবে কিছু সময় দাঁড়িয়ে তাদের প্রতিবাদ জানান।
এ সময় অর্ণব প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখানে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানাতে এসেছি। তবে সময় ব্যবস্থাপনা কিছুটা এলোমেলো হওয়ায় সবাই একসঙ্গে এখানে দাঁড়াতে পারিনি। আগে শিল্পীদের একটি দল এখান থেকে সংহতি জানিয়ে শহীদ মিনারে গেছেন প্রতিবাদী সমাবেশ অংশ নিতে। শিল্পীরা শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছে।’
‘ঘরে থাকতে পারিনি’
বেলা একটা থেকে চারটা পর্যন্ত রবীন্দ্রসরোবর শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছিল। প্রচুর নারী এতে অংশ নেন। কেবল তরুণেরাই নন, মধ্যবয়সী দম্পতি এসেছেন যেমন, তেমনি তরুণ দম্পতিরাও এসেছেন শিশুদের নিয়ে।
এমনই এক দম্পতি আশফিক আহমদ ও পূর্ণতা আহমদ এসেছিলেন তাঁদের সাড়ে তিন বছরের ছেলে ইরফান আহমদকে কোলে নিয়ে। এই দম্পতি থাকেন মিরপুরে। উভয়েই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী। তাঁরা প্রথম আলোকে বললেন, ‘আমাদের সন্তানের সমবয়সী “আহাদ” গুলিতে মারা গেছে। শিশু রিয়া গোপ প্রাণ হারিয়েছে। এসব অবোধ শিশুর মৃত্যু আমাদের ঘরে থাকতে দেয়নি। সন্তানদের জন্য একটি নিরাপদ দেশের দাবি করে আমরা এই গণবিক্ষোভে অংশ নিয়েছি।’
বিকেল চারটার পর বিক্ষুব্ধ জনতা বিরাট মিছিল নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে যাত্রা শুরু করে। ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়ক দিয়ে, সাতমসজিদ রোড, সিটি কলেজ, সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় হয়ে, নীলক্ষেত হয়ে মিছিলটি যতই এগোতে থেকে, সড়কের আশপাশ থেকে অনেক সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে অংশ নিতে থাকেন। হাজার হাজার শিক্ষার্থী, শিশু, কিশোর, তরুণ ও বয়স্ক নর-নারীর বিক্ষোভ মিছিলটি এস এম হলের সামনের সড়ক দিয়ে যখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে পৌঁছায়, তার আগেই শহীদ মিনার পরিণত হয়েছিল এক বিক্ষুব্ধ জনসমুদ্রে।