অব্যবস্থাপনা থেকেই বিদ্যুৎ বিপর্যয়

গ্রিড বিপর্যয় নিয়ে পিজিসিবির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা। উৎপাদন-সঞ্চালন-বিতরণে সমন্বয়ের অভাব।

  • দুই উপকেন্দ্র বন্ধ হয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমে গেছে।

  • একই সময়ে বরাদ্দের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছে বিতরণ কোম্পানি।

  • বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল গ্রিড।

রাজধানীর অনেক এলাকায় চলছে তিন থেকে চার ঘণ্টার বিদ্যুতের লোডশেডিং। বেড়েছে চার্জার লাইট ও ফ্যানের চাহিদা। গতকাল রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ মার্কেটের সামনে
ছবি: প্রথম আলো

উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের মধ্যে সমন্বয়হীনতাই ঝুঁকি তৈরি করছে বিদ্যুৎ খাতে। বিদ্যুৎ সরবরাহের এ প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় করা যায়নি। তাই ফোনে ফোনে নির্দেশনা দিয়ে জাতীয় গ্রিডে চাহিদা ও সরবরাহের সামঞ্জস্য রক্ষা করতে হয়। এতে হেরফের হলেই ঘটতে পারে বিদ্যুৎ বিপর্যয়। সাম্প্রতিক গ্রিড বিপর্যয়ের ক্ষেত্রেও এমন অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছে তদন্ত কমিটি।

গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে দেশের একমাত্র বিদ্যুৎ সঞ্চালন সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) গঠিত তদন্ত কমিটির একাধিক সদস্য বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন। গতকাল রোববার রাতে তদন্ত প্রতিবেদনটি বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে জমা দিয়েছে পিজিসিবি। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইয়াকুব আলী চৌধুরীর নেতৃত্বে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। এর বাইরে বিদ্যুৎ বিভাগ গঠিত আরও একটি তদন্ত কমিটি গ্রিড বিপর্যয় নিয়ে কাজ করছে।

পিজিসিবি তদন্ত কমিটির একাধিক সদস্য বলেছেন, মূলত দুটি কারণে বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটেছে। এর একটি হলো বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণে সমন্বয়ের অভাব। আর দ্বিতীয়টি হলো বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থার বিধিবদ্ধ নিয়ম (রুল বুক) ও গ্রিড কোড কঠোরভাবে না মানা।

বাড়তি বিদ্যুৎ ব্যবহারের কোনো বিষয় তাঁর জানা নেই।
বিকাশ দেওয়ান, ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক

বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র হয়ে বিতরণ কোম্পানির কাছে সরবরাহের কাজটি করে জাতীয় গ্রিড। এটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছে পিজিসিবির অধীনে থাকা সংস্থা ন্যাশনাল লোড ডেসপাচ সেন্টার (এনএলডিসি)। বিদ্যুৎ সরবরাহ কমলে তারা বিতরণ কোম্পানিকে লোডশেডিং করার নির্দেশনা দেয়। এটি সময়মতো করা না গেলে বিপর্যয়ের ঝুঁকি তৈরি হয়।

আরও পড়ুন

দেশে এখন পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল নামে দুটি গ্রিড আছে। ঈশ্বরদী-ঘোড়াশাল এবং সিরাজগঞ্জ-আশুগঞ্জ—এ দুটি লাইনের মাধ্যমে দুই গ্রিড সংযুক্ত আছে। তদন্ত কমিটির সদস্যরা বলছেন, ৪ অক্টোবর দুপুরে হঠাৎ করেই ঘোড়াশাল উপকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এখানে উৎপাদিত ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চলে যায় পশ্চিমাঞ্চলের ঈশ্বরদী এলাকায়।

এতে পূর্বাঞ্চল গ্রিডে ঘাটতি তৈরি হয়। একই সময় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় বরাদ্দের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে থাকে বিতরণ কোম্পানিগুলো। এতে গ্রিডে বিদ্যুতের সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে বড় পার্থক্য তৈরি হয়। বন্ধ হয়ে যায় সিরাজগঞ্জ-আশুগঞ্জ লাইনের উপকেন্দ্র। পূর্বাঞ্চল পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পশ্চিমাঞ্চল থেকে। এতে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। পুরো গ্রিডে নেমে আসে বিপর্যয়।

ঘটনাটি ঘটে ৪ অক্টোবর বেলা ২টা ৫ মিনিটে। পূর্বাঞ্চল জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের একটি বড় অংশ টানা চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকে। ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ ফিরে এলেও কোনো কোনো এলাকায় বিদ্যুৎ আসে আট ঘণ্টা পর।

তদন্ত কমিটির সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। তাদের প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিষয়টি বোঝা যাবে।
আমির কাউসার আলী, ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক

একসঙ্গে ঘটেছে একাধিক ঘটনা

গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছে পিজিসিবির তদন্ত কমিটি। তারা বলছে, ছোটখাটো ঘটনা ঘটতেই থাকে জাতীয় গ্রিডে। তবে একসঙ্গে অনেকগুলো ঘটনা ঘটলেই বিপর্যয় তৈরি হয়। যার সূত্রপাত্র হয়েছে ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে। একই সঙ্গে ঘটতে থাকে বাড়তি বিদ্যুৎ ব্যবহারের ঘটনা। বিপর্যয়ের ঘটনা সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে গেছে।

তদন্ত কমিটি বলছে, সরবরাহ কমার পরও ঢাকার দুই বিতরণ কোম্পানি ডিপিডিসি ও ডেসকো বরাদ্দের চেয়ে বাড়তি বিদ্যুৎ সরবরাহ করে গেছে। একই সময়ে কুমিল্লা এলাকায় বাড়তি বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে পিডিবি ও আরইবি। ওই সময় তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ লোডশেডিং করার কথা, যা করা হয়নি। এতে গ্রিডের ওপর চাপ বেড়েছে। তবে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, বাড়তি বিদ্যুৎ ব্যবহারের কোনো বিষয় তাঁর জানা নেই। আর ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির কাউসার আলী প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত কমিটির সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। তাদের প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিষয়টি বোঝা যাবে।

বিতরণ কোম্পানির বাইরে একই সময়ে হঠাৎ বিদ্যুৎ ব্যবহার বাড়িয়েছে চট্টগ্রামের একটি ভারী শিল্পকারখানা। চট্টগ্রামে কয়েকটি ভারী শিল্পকারখানা সরাসরি গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ নেয়। বিপর্যয়ের সময় হঠাৎ করেই ওই শিল্পকারখানা ২০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ নিতে থাকে। এতে গ্রিডে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ চাহিদার চাপ তৈরি হয়। ঘোড়াশাল উপকেন্দ্র বন্ধ হওয়ার কয়েক মিনিট পরও যদি এ কারখানা চালু হতো, তাহলেও হয়তো বিপর্যয় এড়ানো যেত।

অব্যবস্থাপনা অন্যতম বড় কারণ। ইতিমধ্যে পিজিসিবির দুজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বিতরণ কোম্পানির যাঁরা জড়িত, তাঁদেরও বহিষ্কার করা হবে। বিদ্যুৎ সরবরাহের স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি থাকলে এমন বিপর্যয়ে পড়তে হতো না। নানা কারণে স্বয়ংক্রিয় করার প্রকল্প পিছিয়ে গেছে।
নসরুল হামিদ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী

দায়ীদের খুঁজছে বিদ্যুৎ বিভাগ

পিজিসিবির তদন্ত কমিটির দুজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলছেন, বিদ্যুৎ সরবরাহে জড়িত সবাইকে রুল বুক ও গ্রিড কোড মানতে হবে। এ ক্ষেত্রে চালকের আসনে থাকবে পিজিসিবি। চট্টগ্রামের শিল্পকারখানায় বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানো বা কমানোর সময় একটু ঝামেলা তৈরি হয়। এটি নিয়মিত বিষয়, এতে গ্রিড বিপর্যয় হয় না। কিন্তু ওই দিন গ্রিডের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে তাদের বাড়তি ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। এটি ব্যবস্থাপনার ঘাটতি।

তদন্ত কমিটির দুজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবেদনে কারিগরি বিশ্লেষণ করা হয়েছে, হাতে সময় ছিল কম। এক বা একাধিক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা কাজ ছিল না। বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা এনএলডিসির কর্মকর্তাদের গাফিলতি থাকতে পারে। আবার চাহিদা কমানোর কথা বলা হলেও অনেক সময় বিতরণ কোম্পানি তাঁদের কথা শোনে না।

অনেক আগেই বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা স্বয়ংক্রিয় করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু করা হয়নি। ফোনে ফোনে নির্দেশনার প্রক্রিয়ায় মূল দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা কঠিন। কিছু ব্যক্তিকে দোষারোপ করা হবে।
ম তামিম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী

বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের জন্য দায়ীদের খুঁজছে বিদ্যুৎ বিভাগ। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে গতকাল পিজিসিবির দুজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একই অভিযোগে অভিযুক্ত বিতরণ কোম্পানির কর্মকর্তাদেরও খোঁজা হচ্ছে। সাত-আটজনকে সন্দেহ করা হচ্ছে। এ সপ্তাহের মধ্যেই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, অব্যবস্থাপনা অন্যতম বড় কারণ। ইতিমধ্যে পিজিসিবির দুজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বিতরণ কোম্পানির যাঁরা জড়িত, তাঁদেরও বহিষ্কার করা হবে। বিদ্যুৎ সরবরাহের স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি থাকলে এমন বিপর্যয়ে পড়তে হতো না। নানা কারণে স্বয়ংক্রিয় করার প্রকল্প পিছিয়ে গেছে।

ঝুঁকি আছে আরও বিপর্যয়ের

এর আগে ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর আরও বড় বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল জাতীয় গ্রিডে। ওই সময় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ সঞ্চালনব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল করা, কারিগরি সব ব্যবস্থার উন্নয়নসহ মোট ৩২ দফা সুপারিশ করা হয়েছিল। এরপর আট বছর পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে আরও অন্তত তিনবার জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় ঘটেছে।

বিভিন্ন সময়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সব সময় উৎপাদন-সঞ্চালন-বিতরণে সমন্বয় রাখতে হবে। না হলে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের উৎপাদন কমে যাওয়ায় গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে। এ জন্য চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সুপারিশের মধ্যে ঘুরেফিরে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা আধুনিক করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। তবে সব বিদ্যুৎকেন্দ্রকে এখন পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনায় আনা যায়নি।

একসময় দেশে সব বিদ্যুৎ উৎপাদন করত শুধু পিডিবি। এখন বেসরকারি খাতে নানা ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকেও বিদ্যুৎ এসে যুক্ত হচ্ছে জাতীয় গ্রিডে। এতে যথাযথ সমন্বয় না হলে সরবরাহ ও তাৎক্ষণিক চাহিদার (লোড) হেরফের হওয়ার ঝুঁকি থাকে। উৎপাদন-সঞ্চালন-বিতরণের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা যায়নি।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, অনেক আগেই বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা স্বয়ংক্রিয় করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু করা হয়নি। ফোনে ফোনে নির্দেশনার প্রক্রিয়ায় মূল দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা কঠিন। কিছু ব্যক্তিকে দোষারোপ করা হবে। বর্তমানে প্রচলিত বিদ্যুৎ সরবরাহকাঠামোয় কোনো জবাবদিহি নেই। এতে আরও বিপর্যয়ের ঝুঁকি থেকেই যায়।