‘মুক্তিযুদ্ধ আমাকে এখনো স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করে চলেছে’

েরেহমান সোবহান অর্থনীতিবিদ, জনবুদ্ধিজীবী এবং বাংলাদেশের প্রভাবশালী চিন্তাশালা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রতিষ্ঠাতা। জন্ম ১৯৩৫ সালে। মুক্তিযুদ্ধের আগে বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যে বাংলাদেশে মুক্তির আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কাজ করেছেন বিশ্বজনমত গঠনে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন।

১৯৯০ সালে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে নেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি স্মৃতিচারণা করেছেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং অব্যবহিত আগের দিনগুলোর কথা। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে কী রকম রাষ্ট্র আমরা চেয়েছিলাম, তার কথা। বলেছেন সেই লক্ষ্য পূরণে আমাদের কর্তব্যের কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ

রেহমান সোবহান

প্রশ্ন :

সাজ্জাদ শরিফ: ১৯৬০-এর দশকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের ব্যাপারে আপনি আগ্রহী হয়ে উঠলেন কীভাবে?

রেহমান সোবহান: অধ্যাপক কবীর চৌধুরী সে সময়ে ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন বা বিএনআরের কাজ করতেন। ১৯৫৯ সালের কোনো এক সময় তিনি আমাকে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি সম্পর্কে বিএনআরের প্রকাশিতব্য জার্নালে একটা অধ্যায় লিখতে বললেন। প্রকাশনাটির উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবত রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের সামরিক শাসনব্যবস্থার কৃতিত্ব প্রচার করা। লেখাটির জন্য গবেষণা করতে গিয়ে আমি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের বেশ কিছু প্রমাণ পেয়ে গেলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের নুরুল ইসলাম অথবা অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকসহ আরও কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে আলোচনার সুবাদে এ সম্পর্কে আগেও কিছু ধারণা আমার ছিল। বিএনআরের প্রকাশনায় আমার লেখাটিও অন্তর্ভুক্ত হলো। লেখাটিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য বিশদভাবে তুলে ধরেছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান সরকার বিষয়টি একদমই পছন্দ করেনি। তাদের হুকুমে আমার লেখা প্রত্যাহার করে অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যাপক আবদুল্লাহ ফারুকের লেখা একটি ইতিবাচক নিবন্ধসহ জার্নালটি আবার নতুন করে ছাপা হয়।
এর পরে আমি বৈষম্য বিষয়ে আরও নিয়মিত লিখতে শুরু করলাম। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমি নিবন্ধ লিখতাম, সভা-সমিতিতে বিষয়টি নিয়ে বলতাম। ১৯৬১ সালের অক্টোবরে যখন লাহোরে এক জাতীয় সম্মেলনে এই দুই অর্থনীতি নিয়ে আমার নিবন্ধটা পড়লাম, তখন তার ব্যাপক প্রচার হয়েছিল। ঢাকার পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় পুরো লেখা ছাপা হয়েছিল।

প্রশ্ন :

সাজ্জাদ শরিফ: শুরুতে আপনার কি মনে হয়েছিল, আপনার সমীক্ষা একাডেমিক পরিসরেই থেকে যাবে? নাকি এমন ভেবেছিলেন যে এটি বাস্তব রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বা গণ-আন্দোলনের ওপর প্রভাব রাখতে পারবে?

রেহমান সোবহান: বিএনআরের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা আর পত্রপত্রিকায় আমার লেখালেখির যে প্রতিক্রিয়া পাচ্ছিলাম, তা আমাকে এই বৈষম্যের রাজনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন করে তুলল। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্রজীবন থেকে এবং পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাকালেও জনমত ও রাজনৈতিক মতামতকে প্রভাবিত করার ব্যাপারে আমি আগ্রহী ছিলাম। গবেষণাধর্মী ও জনপ্রিয়—আমার এই দুই ধরনের লেখালেখির কেন্দ্রে নিয়মিতই আমি নীতিনির্ধারণী রাজনৈতিক অর্থনীতির বিষয়টিকে রাখতাম। এখনো আমি তা-ই করি, সারা জীবনই করেছি—২৫ থেকে শুরু করে এই ৮৫ বছর বয়স পর্যন্ত।

প্রশ্ন :

সাজ্জাদ শরিফ: আপনার গবেষণা আর পর্যবেক্ষণ আপনাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংস্পর্শে নিয়ে এল এবং আপনি তখনকার আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িয়ে গেলেন। ঘটনার পরম্পরাটা বলবেন?

রেহমান সোবহান: বঙ্গবন্ধুসহ অন্য যেসব বাঙালি রাজনীতিবিদ তখন বাঙালিদের অধিকার আদায়ের লড়াই করছিলেন, তাঁরা আমার লেখা এবং সংবাদপত্রে আমার বক্তব্য নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার দিকে খেয়াল রেখেছিলেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২, সামরিক শাসনের সময় রাজনীতিবিদদের জনসমক্ষে কিছু বলার অধিকার ছিল না। কাজেই জনগণের পক্ষ থেকে বিশেষ করে বৈষম্যের মতো অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো বুদ্ধিজীবীরাই উপস্থাপন করতেন। সামরিক শাসনামলে বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবীই জনসমক্ষে ভাষণ দেওয়া অথবা পত্রিকায় লেখালেখি করতে চাইতেন না। আমরা যে অল্প কয়জন সে সময় বলতাম বা লিখতাম, আমরা তাই একটু বেশিই প্রচার পেয়েছিলাম। আমি তখন অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৬ বছর বয়সী একজন প্রভাষক মাত্র। বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো আরও ভালোভাবে বুঝতে চাইছিলেন। ১৯৬৪ সালের নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের ইশতেহার তৈরির কাজে আমাকে তিনি ডাকলেন। সে সময় নির্বাচনী প্রচারে আইয়ুব খান সরকার তাঁর শাসনামলে অর্থনৈতিক কৃতিত্বের যে দাবি জানিয়েছিলেন, সেটি চ্যালেঞ্জ করে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তৈরিতে আমি সাহায্য করেছিলাম।

প্রশ্ন :

সাজ্জাদ শরিফ: আপনার সমীক্ষা কি গণ-আন্দোলনকে কোনোভাবে প্রভাবিত করেছিল?

রেহমান সোবহান: গণ-আন্দোলনের ওপর আমার কাজের সম্ভবত সরাসরি কোনো প্রভাব ছিল না। তবে দেশের দুই অংশের অর্থনৈতিক বৈষম্য বিষয়ে আমাদের চিন্তা ছয় দফা দাবি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধুসহ অন্য রাজনীতিবিদেরা এসব ভাবনা গণজাগরণের উদ্দেশ্যে তাঁদের রাজনৈতিক বক্তৃতায় ব্যবহার করতেন। সে হিসেবে আমার কাজের পরোক্ষ প্রভাব ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও ১৯৬০-এর দশকের গণ-আন্দোলনের সময় আমাদের চিন্তা থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছে।

প্রশ্ন :

সাজ্জাদ শরিফ: এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে একাডেমিক বিদ্যাচর্চা আর বাস্তব রাজনীতি সে সময় মিলেমিশে গেল। বঙ্গবন্ধু আশ্চর্যভাবে এ দুটোকে এক করলেন। এরপর আপনি পূর্ববঙ্গের মুক্তির আন্দোলনে যুক্ত হয়ে গেলেন। শেখ মুজিবের মধ্যে ভরসা করার মতো এমন কী দেখতে পেয়েছিলেন যে আপনি সেই বিপজ্জনক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যুক্ত হওয়ার সাহস পেলেন?

রেহমান সোবহান: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রাথমিক রাজনৈতিক সাক্ষাতের সময়েই টের পেয়েছিলাম, তিনি এমন একজন নেতা, যিনি জনতার কাছে পৌঁছাতে পারেন। তাই মনে হলো, যদি আমরা পূর্ব পাকিস্তানে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন আনতে চাই, তবে সে আন্দোলনে তিনি হবেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। বঙ্গবন্ধুও আমাদের লক্ষ্য করছিলেন। তিনি আমাদের লেখালেখির কদর করতেন এবং আমাদের কাছ থেকে বুঝতে আগ্রহী ছিলেন। যে বুদ্ধিজীবী রাজনৈতিক অর্থনীতির বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করেন, তাঁর সে কাজ যে কোনো বড় রাজনীতিবিদ লক্ষ করছেন—এর চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু আইয়ুব-মোনেমের শাসনকালে বিরোধী দলের রাজনীতিবিদদের সংস্পর্শে আসা বুদ্ধিজীবীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। সে ঝুঁকি নিতে আমি প্রস্তুত ছিলাম। এ কারণে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যরা বাসায় আমার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে হাজির হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে আমি তখন বাড়িতে ছিলাম না। পরের নয়টা মাস আমি স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ার কাজ করেছি।

প্রশ্ন :

সাজ্জাদ শরিফ: আপনি এবং আপনার মতো বিদ্যায়তনের অন্য লোকেরা যুক্ত হওয়ায় তাৎপর্যপূর্ণ ফলটা কী দাঁড়াল?

রেহমান সোবহান: আমাদের বেশ লাভ হলো। এর ফলে আমরা একাডেমিক দুনিয়ার নিছক দর্শকের ভূমিকা থেকে বেরিয়ে এসে এই জীবনমরণ যুদ্ধে শরিক হওয়ার শক্তি পেয়েছিলাম। আরেক দিক থেকে আন্দোলনের প্রথম সারির নেতারা তাঁদের বিকল্প নীতিমালাগুলো জনগণের সামনে পেশ করার সময় বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সহযোগিতা পেয়েছেন। আমার লেখালেখির সাবলীলতা এবং ইংরেজিতে বিতর্ক করার পারদর্শিতা ভালো ইংরেজি জানা পাকিস্তানিদের চ্যালেঞ্জ করার জন্য ব্যবহার করা হতো।

প্রশ্ন :

সাজ্জাদ শরিফ: আমরা দেখতে পাচ্ছি, আপনি কখনো পেছন থেকে, কখনো পাশে থেকে শেখ মুজিবকে সহায়তা করেছেন—সত্তরের নির্বাচনের আগে, পরে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। খুব কাছ থেকে আপনি ইতিহাসের পালাবদল দেখেছেন। রাজনীতির শর্ত তখন তৈরি হচ্ছিল পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা মানুষের সপ্রাণ অংশগ্রহণে। একাডেমির মানুষ হিসেবে আপনি কী দেখছিলেন, কী শিখছিলেন?

রেহমান সোবহান: ১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচার ছিল বেশ ব্যতিক্রমধর্মী। কারণ, সেটির কারণেই বঙ্গবন্ধুর মতো রাজনীতিবিদেরা ১৯৫৪ সালের পর প্রথমবারের মতো জনতার সামনে দাঁড়াতে পেরেছিলেন। আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বেশ কিছু জনসভায় গিয়েছি। তিনি যেভাবে মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতেন, যেভাবে তাদের কাছে তিনি কেবল একজন রাজনৈতিক নেতা নন, বরং একটি আইকনে পরিণত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে সেসব দেখতে পাওয়া আমার জন্য ছিল একটি অনন্য অভিজ্ঞতা। ছয় দফা দাবির মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বার্তা যাতে ঘরে ঘরে, এমনকি একেবারে অজপাড়াগাঁয়ে গিয়েও পৌঁছায়—১৯৭০ সালের প্রচারের সময় সেদিকে লক্ষ রাখাই ছিল আমার দায়িত্ব।
ডিসেম্বর ১৯৭০-এর ভোটেই শুধু নয়, ১৯৭১ সালের মার্চেও যখন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাক্রমকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন—এই জনতাই তাদের সবকিছু দিয়ে তাঁকে সমর্থন করেছে। ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলন সর্বস্তরের সব শ্রেণির মানুষের সমর্থন পেয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বাঙালি সেনাবাহিনী আর সাধারণ মানুষকে এ সমর্থন শক্তি জুগিয়েছে।
এসব ঐতিহাসিক ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম, অভিজাত শ্রেণিকে কেন্দ্র করে অসম যে সমাজব্যবস্থা পাকিস্তানের উন্নতিকে আকার দিয়েছে, কিছুতেই তা স্বাধীন বাংলাদেশে চলতে দেওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধুসহ স্বাধীনতাযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া আরও অনেকের মতো আমিও বিশ্বাস করতাম, আমাদের অবশ্যই একটা ন্যায়পরায়ণ ও সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে হবে।

প্রশ্ন :

সাজ্জাদ শরিফ: মুক্তিযুদ্ধ চলে এল। সেটা তো স্নায়ুযুদ্ধের যুগ। বিশ্বশক্তির মধ্যে নানা বিভেদ। বঙ্গবন্ধু বন্দী। নেতাদের নানা অংশে নানা মত। অথচ সব পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিরাট সাফল্য এল। এত বাধা পেরিয়ে এই সফলতার পেছনে প্রধান কারণগুলো কী ছিল?

রেহমান সোবহান: বঙ্গবন্ধু তখন পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে বন্দী থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সফলতার মূল কারণ ছিল যুদ্ধটি তাঁর মতো একজন অবিসংবাদিত নেতার নামে পরিচালিত হয়েছে। তাঁর দল আওয়ামী লীগের পেছনে ছিল নির্বাচনে তাদের আকাশচুম্বী জয়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ নাগাদ বঙ্গবন্ধু সারা বিশ্বে সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। এ কারণে ১৯৭১ সালে আমাদের যুদ্ধ আন্তর্জাতিক দৃশ্যমানতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে।
একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রচারণায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রবাসী বাঙালিরা যুক্ত হয়েছিলেন। এটি বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিমণ্ডল, জনগোষ্ঠী আর গণমাধ্যমে খুব কার্যকরভাবে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ইয়াহিয়া সরকারের প্রতি নিক্সন সরকারের সমর্থনে বাধা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের আন্তর্জাতিক প্রচারণা চালু করা গেছে, ইয়াহিয়ার সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রের বেশি পরিমাণে অর্থনৈতিক সাহায্য আর অস্ত্রের জোগান দেওয়ার সামর্থ্য সংকুচিত হয়েছে। মুজিবনগর সরকারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের দূত হিসেবে আমি এ রকম একটি প্রচারণার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমরা চেষ্টা চালাচ্ছিলাম যাতে পাকিস্তানি এইড কনসোর্টিয়াম পাকিস্তানে নতুন সাহায্য পাঠানো বন্ধ রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপ থাকা সত্ত্বেও আমরা কার্যকর হয়েছিলাম। বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে পাকিস্তানের সাহায্য সংস্থাগুলো ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত পাকিস্তানে সাহায্য পাঠানো বন্ধ রেখে ইয়াহিয়া সরকারকে খুব সমস্যায় ফেলেছিল।

প্রশ্ন :

সাজ্জাদ শরিফ: মুক্তিযুদ্ধ আমাদের কী দিয়েছে?

রেহমান সোবহান: জাতীয় মুক্তি আমাদেরকে যা দিয়েছে, তা হলো নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা, তা সে সিদ্ধান্ত ভুল বা সঠিক, যা-ই হোক না কেন। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ব্রিটেন আর তারপর পাকিস্তানের মতো শাসকদের কর্তৃত্ব থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের জনগোষ্ঠী তার প্রতিটি অংশে শিল্পোদ্যোগের স্পৃহা সঞ্চার করতে পেরেছে। এ কারণে আমাদের অর্থনীতির ওপর থেকে ব্রিটিশ এবং অবাঙালি ক্ষমতাবান ব্যবসায়ীদের আধিপত্য হটে গিয়েছে। এই অর্থপূর্ণ পরিবর্তন স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে লক্ষ করা গেছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ক্ষুদ্র কৃষক, নারী কর্মী, ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা, অভিবাসী শ্রমিক, পোশাক রপ্তানিকারক, প্রযুক্তি উদ্যোক্তা, ফজলে হাসান আবেদ বা মুহাম্মদ ইউনূসের মতো বেসরকারি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা প্রভৃতির মধ্যে উদ্যোগী গতিশীলতা দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এসবের মধ্যে কিছু নেতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও এর ফলে আমরা ভিক্ষার ঝুলি ফেলে দিয়ে উন্নীত হয়েছি একটি সম্ভাবনাময় অর্থনীতিতে। আমাদের শাসনব্যবস্থার মান উন্নত করতে পারলে এখান থেকে আমরা আকাশ ছুঁতে পারব।

প্রশ্ন :

সাজ্জাদ শরিফ: বিশ্ববাসী যেসব আদর্শ সভ্যতার উত্তরাধিকার হিসেবে সহজেই পেয়েছে—যেমন গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য ইত্যাদি—এসব আমাদের অর্জন করতে হয়েছে রক্তের মূল্যে। এটা কি জাতি হিসেবে আমাদের ওপর অতিরিক্ত কোনো দায় অর্পণ করেছে?

রেহমান সোবহান: যে জনতা প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে এবং নিজের জীবন ও বিষয়সম্পত্তি হারিয়ে সবচেয়ে বড় মূল্য দিয়েছে, তাঁদের কাছে আমাদের রক্তের ঋণ আছে। ক্ষমতাবানেরা যেভাবে ক্ষমতা ও সম্পদ আত্মসাৎ করছে, বাড়তে থাকা অর্থনৈতিক ব্যবধান আর সামাজিক বৈষম্য ইঙ্গিত দেয় যে আমাদের সে রক্তের ঋণ এখনো শোধ হয়নি।

প্রশ্ন :

সাজ্জাদ শরিফ: ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দটা আমরা নানাভাবে ব্যবহার করি। আপনি কীভাবে এই শব্দ ব্যাখ্যা করেন?

রেহমান সোবহান: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংবিধানের প্রতিষ্ঠা নীতিমালাতেই পুরোপুরি ধরা আছে—গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা আর সমাজতন্ত্র।

প্রশ্ন :

সাজ্জাদ শরিফ: বিপুল স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হলো। স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলাম, সেটি পরিচালনার সুযোগ পেলাম। মোটাদাগে এর সুফল আমরা কতটা গ্রহণ করতে পেরেছি?

রেহমান সোবহান: আমাদের অর্থনীতি অনেক বেশি বহুমুখী ও বিকশিত হয়েছে, রপ্তানি সন্তোষজনক হারে বেড়েছে, ভালো পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষিত আছে এবং আমাদের অর্থনৈতিক অবকাঠামো যথেষ্ট পরিমাণে শক্তিশালী হয়েছে। এসব অর্জনের সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রমাণ হলো পদ্মা সেতু। একই সঙ্গে আমাদের দারিদ্র্য কমেছে, শিক্ষা ও চিকিৎসার মান বেড়েছে।
তবে যা এখনো সত্যি হয়নি, তা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুরোপুরি সম্মান দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে জীবিত রাখা। আমাদের গণতান্ত্রিক পথযাত্রা বারবার ব্যাহত হয়েছে এবং কখনো কখনো উল্টো পথে চলছে। অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীর তুলনায় ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিশ্রুতি ভালোভাবে বজায় রাখলেও আমাদের দেশের সংখ্যালঘু মানুষের মনে এখনো আমরা সমতার অনুভূতি নিশ্চিত করতে পারিনি। আমরা জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রমাণ দিয়েছি—এখন আমরা আর বিদেশি অনুদান অথবা পরামর্শের মুখাপেক্ষী নই। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি থেকে আমরা বহু দূরে সরে এসেছি। ধনবানেরা এ দেশের অর্থনীতিকে গ্রাস করে নিয়েছে এবং রাজনীতি এখন ক্ষমতা ও টাকার জিম্মায় চলে গেছে। রাষ্ট্রের পরাক্রমশালী ক্ষমতার সামনে এসব অবিচারের বিরুদ্ধে কিছু বলা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠেছে এবং নাগরিক অধিকার রক্ষার বিষয়ে আমাদের আদালতগুলো ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়েছে।

প্রশ্ন :

সাজ্জাদ শরিফ: আমরা দেখেছি, স্বাধীনতার পরও রাজনীতি আর বিদ্যাচর্চার যোগসূত্র শুরুতে কিছুদিন কাজ করেছে। কিন্তু গত ৫০ বছরে আস্তে আস্তে এই দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান শুধু বাড়েইনি, একপর্যায়ে ছিন্ন হয়ে গেছে। কখনো কখনো মুখোমুখিও দাঁড়িয়ে গেছে। ক্ষমতা কি বিদ্যাচর্চার কাছে শুধু আনুগত্যই চায়?

রেহমান সোবহান: একটি সক্রিয় গণতন্ত্রের দেশে জ্ঞানচর্চা ও ক্ষমতা পাশাপাশি না থাকতে পারার তো কোনো কারণ নেই। পশ্চিমে এনলাইটেনমেন্টের কেন্দ্রে জন্ম নেওয়া এ বার্তা তো আমাদের সংবিধানেও আত্মস্থ করা হয়েছিল। কিন্তু বিদ্যাচর্চার মাধ্যমে সত্যের অনুসন্ধান এবং লেখালেখির মাধ্যমে তার প্রকাশকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে যখন দমন করা শুরু হলো, তখনই সমস্যার সূত্রপাত। যে সমাজব্যবস্থায় বিদ্যাচর্চার পায়ে শিকল পরানো হয়, সেখানে শিক্ষার মান পড়ে যায় এবং স্বল্পশিক্ষিত জনতা সহজেই চতুর জননেতাদের কথার ফাঁদে আটকে পড়তে পারে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শাসনকালে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত এ রকমই এক সমাজের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে উঠেছিল যে সমাজ মিথ্যাচারকে ক্ষমতাবানদের রাজনৈতিক সংস্থান বানিয়ে নিয়েছে। অবশ্য আমাদের ঘরের কাছে এবং নিজেদের অভিজ্ঞতার মধ্যেও এই ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটেছে।

প্রশ্ন :

সাজ্জাদ শরিফ: ২০২১ সাল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। আমরা কীভাবে এই সময়কে অর্থপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারি? এ নিয়ে আমাদের জাতীয় অ্যাজেন্ডা কী হওয়া উচিত?

রেহমান সোবহান: আমাদের উচিত এত দিনের অর্জনগুলো আরও সমৃদ্ধ করা। বঙ্গবন্ধুর অসমাধেয় স্বপ্নগুলো পূরণ করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিষয়ে প্রতিশ্রুতির নবায়ন করা।

প্রশ্ন :

সাজ্জাদ শরিফ: সময় পাল্টায়, আমরা ভবিষ্যতের নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই। এই ভবিষ্যতের সামনে জাতীয় স্মৃতি ও জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা নতুন ব্যাখ্যায় হাজির হয়। মুক্তিযুদ্ধকে এ সময়ে আপনি কি নতুন তাৎপর্যে দেখছেন?

রেহমান সোবহান: মুক্তিযুদ্ধের মূল ভাবনা ছিল বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া; আর এ দেশের জনতার, বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতায়ন—যাতে তারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নিজেদের পুরো সম্ভাবনা বিকাশের সুযোগ পায়। অর্ধশতক পার হয়ে গেছে, অথচ একটি ন্যায়পরায়ণ সমাজ নিয়ে আমাদের ভাবনাগুলো উপেক্ষিতই থেকে গেল।

প্রশ্ন :

সাজ্জাদ শরিফ: আপনি একটি দীর্ঘ জীবন পাড়ি দিয়ে এসেছেন। মুক্তিযুদ্ধ আপনার সেই জীবনে কী ভূমিকা রেখেছে?

রেহমান সোবহান: আমার জীবনে মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক সন্ধিক্ষণ। বাংলাদেশের জন্য বিদেশে ৯ মাস প্রচারণার কাজ চালানোর পর ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর যখন ঢাকার বিমানবন্দরে নামলাম, তখন এমন এক পরিপূর্ণতার অনুভূতি হয়েছিল, সেটি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারা আমাকে একটি গৌরব ও আত্মমর্যাদার বোধ দিয়েছিল। কারণ, এ দেশের প্রতিষ্ঠায় আমিও যৎসামান্য ভূমিকা রাখতে পেরেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, এমনকি এই ৮৫ বছর বয়সেও এমন স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করে চলেছে যে আমরা সেই ন্যায়পরায়ণ সমাজ গড়ে তুলতে পারব, যার জন্য একদিন যুদ্ধ করেছি এবং বহু মানুষ প্রাণ দিয়েছেন।

সূত্র: ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে প্রথম আলো প্রকাশিত ম্যাগাজিন, সম্পাদক: আনিসুল হক, ২০২১