চট্টগ্রামের পাঁচ সরকারি কলেজ ধুঁকছে শিক্ষক সংকটে

চট্টগ্রাম কলেজফাইল ছবি

চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং ও মার্কেটিং বিষয়ে স্নাতক চালু হয় ২০১৮ সালে। বর্তমানে এ দুই বিভাগে পড়ছেন প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থী। কিন্তু বিভাগে একজনও শিক্ষক নেই। ছয় বছরেও শিক্ষক পদ সৃষ্টি হয়নি। এখন ধার করা শিক্ষকে পাঠদান চলছে।

জানা গেছে, হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকেরা ফাঁকে ফাঁকে ফিন্যান্স বিভাগে পাঠদান করান। একইভাবে ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষকেরা মার্কেটিংয়ে গিয়ে ক্লাস নেন। এতে শিক্ষকদের বাড়তি চাপ নিতে হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান কার্যক্রম। এ ছাড়া নিয়মিত ক্লাসও হয় না।

শুধু এ দুই বিভাগে নয়, শিক্ষকের সংকট আছে কলেজের আরও পাঁচটি বিভাগে। সাতটি বিভাগে স্নাতক (সম্মান), স্নাতক (পাস) ও দুটি বিভাগে স্নাতকোত্তর পড়ানো হয় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আছে উচ্চমাধ্যমিকও। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে আট হাজার। কিন্তু শিক্ষক আছেন মাত্র ২৫ জন। অর্থাৎ ৩৪০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক।

শিক্ষকেরা বলছেন, চট্টগ্রাম শহরে এমন নামকরা কলেজ শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে। দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে ছয় বছরেও শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এটি বিস্ময়কর বটে। শিক্ষার্থীরা ঘাটতি নিয়েই পাস করেছেন।

কলেজের অধ্যক্ষ সুশেন বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষক না দিয়ে বিভাগ খোলা হয়েছে। এখন চোখের চিকিৎসক দিয়ে হৃদ্যন্ত্রের চিকিৎসা করানো হচ্ছে। অর্থাৎ হিসাববিজ্ঞানের শিক্ষকেরা ফিন্যান্স পড়াচ্ছেন। ব্যবস্থাপনার শিক্ষকেরা নিচ্ছেন মার্কেটিংয়ের ক্লাস। ফলে দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাবে বিভাগ দুটি ধুঁকছে। শিক্ষক নিয়োগ দিতে কয়েকবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানানো হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি।’

কলেজটি এত দিন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হতো। তদারকি বলতে কিছুই ছিল না বলে অভিযোগ আছে। এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) তত্ত্বাবধানে নেওয়া হয়েছে। ফলে আগের চেয়ে কলেজে শিক্ষার মান বাড়বে, এমনটি প্রত্যাশা করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

অবশ্য আরও যে চারটি কলেজ সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়া হয়েছে, সব কটিতেই শিক্ষক–সংকট রয়েছে। বাকি চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো চট্টগ্রাম কলেজ, হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজ ও সাতকানিয়া সরকারি কলেজ। ৪ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে অধিভুক্ত করার কথা জানায়। এরপর ৫ এপ্রিল বেলা আড়াইটায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবু তাহেরের সঙ্গে সভা করেন পাঁচ কলেজের অধ্যক্ষরা। সভায় ভর্তিপ্রক্রিয়া, শিক্ষক ও অবকাঠামোর সংকট নিয়ে আলোচনা হয়।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, কলেজগুলো বর্তমানে কীভাবে চলছে, তা জানতে সভা করা হয়েছে। এতে শিক্ষক–সংকট, পাঠদানপদ্ধতি ও ভর্তিপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। শিগগিরই পাঁচ কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে আবার সভা হবে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিনরাও থাকবেন। এতে কর্মপরিকল্পনা উঠে আসবে।

পাঁচ কলেজের অধ্যক্ষরা প্রথম আলোকে বলেন, আগে স্নাতকে ভর্তি হতে কোনো পরীক্ষা ছিল না। উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্তি হওয়া যেত। এখন থেকে এই পাঁচ কলেজে স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তিতে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হবে—প্রাথমিকভাবে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। শিগগিরই চূড়ান্ত করা হবে।

শিক্ষক–সংকট সবখানেই

চট্টগ্রাম কলেজের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক (সম্মান), স্নাতক (পাস কোর্স) ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে শিক্ষার্থী আছেন প্রায় এক হাজার। বিপরীতে শিক্ষক আছেন মাত্র তিনজন। শিক্ষক দরকার অন্তত ১২ জন। ফলে তিনজনকে বাড়তি চাপ নিতে হচ্ছে।

বর্তমানে কলেজে উচ্চমাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১৮ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছেন। শিক্ষক আছেন ১৫৫ জন। কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, ঠিকভাবে পাঠদান করাতে গেলে অন্তত ২০৪ জন শিক্ষক প্রয়োজন। ফলে ৪৯ জন শিক্ষকের ঘাটতি নিয়েই ক্লাস পরিচালনা করতে হচ্ছে।

কলেজের অধ্যক্ষ মো. মোজাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকার কারণে শ্রেণি কার্যক্রম নিয়মিত নেওয়া সম্ভব হয় না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এত দিন তেমন তদারকি ছিল না। শুধু সময়ে সময়ে পরীক্ষার আয়োজন করা হতো। এ ছাড়া শিক্ষকদের নিয়ে কিছু প্রশিক্ষণ করাত।

চট্টগ্রামের আরেক ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজও শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা হয়নি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থী আছেন প্রায় ১৫ হাজার। বিপরীতে শিক্ষক আছেন ৬৮ জন। এই কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক (সম্মান), স্নাতক (পাস) ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে শিক্ষার্থী আছেন প্রায় ১ হাজার ১৫০ জন। শিক্ষক আছেন দুজন। এই দুজন আবার উচ্চমাধ্যমিকের ৬০০ শিক্ষার্থীকে পৌরনীতি পড়ান।

কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে বাড়তি ক্লাস নিতে গিয়ে শিক্ষকেরা হাঁপিয়ে ওঠেন। তাই কলেজের মান বাড়াতে হলে শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করতে হবে।

অন্যদিকে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় অবস্থিত স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সব মিলিয়ে ৫ হাজার ৭৭৪। শিক্ষকের সংখ্যা ৩১। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও হিসাববিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক রয়েছে। কলেজের অধ্যক্ষ পার্থ প্রতীম ধর বলেন, উচ্চমাধ্যমিক থেকে শুরু করে স্নাতক পর্যন্ত সব শিক্ষার্থী বাধ্যতামূলকভাবে বাংলা পড়েন। কিন্তু শিক্ষক আছেন মাত্র একজন। এতে করে সব শ্রেণিতে নিয়মিত পাঠদান সম্ভব হয় না। একজন অতিথি শিক্ষক রাখা হলেও তিনি নিয়মিত আসেন না। কারণ, তাঁর আসার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে শিক্ষক না থাকার কারণে পাঠদান, সহশিক্ষা কার্যক্রম, প্রশাসনিক কাজকর্ম ও পরীক্ষা পরিচালনায় সমস্যা হচ্ছে।

একজন শিক্ষক, শিক্ষার্থী দেড় হাজার

সাতকানিয়া সরকারি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক পর্যায়ে চারটি বর্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০০। উচ্চমাধ্যমিকে পৌরনীতি পড়েন আরও এক হাজার। অথচ এই শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক আছেন মাত্র একজন। তিনিই চার বর্ষে ক্লাস নেন। আবার উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের পৌরনীতি পড়ান।

একজনের পক্ষে কীভাবে এত শিক্ষার্থীকে পাঠদান করানো সম্ভব হচ্ছে, তা জানতে চাইলে কলেজের অধ্যক্ষ আবু বকর মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাত্র একজন শিক্ষক দিয়ে কীভাবে পাঠদান হচ্ছে, তা আপনিই বুঝে নেন। মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে কম বেতনে দুজন অতিথি শিক্ষক রাখা হয়েছে। তাঁরাও ক্লাস নেন। কিন্তু কোয়ালিটি এডুকেশন পাচ্ছে না।’ অধ্যক্ষ আবু বকর মজুমদার জানান, ইতিহাস বিভাগের অবস্থাও একই। সেখানেও মাত্র একজন শিক্ষক। অথচ শিক্ষার্থী আছেন প্রায় এক হাজার। ফলে দুজন অতিথি শিক্ষক রেখে কোনোরকমে চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষক না থাকার কারণে নিয়মিত ক্লাস নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া কলেজে শিক্ষার্থী ছয় হাজার। শিক্ষকের অনুমোদিত পদ ৭৩ টি। অথচ শিক্ষক আছেন ৪০ জন। অর্থাৎ ৩৩টি পদই খালি।

‘অবিশ্বাস্য, এভাবে চলতে পারে না’

শিক্ষক ছাড়া কোনো কলেজই চলতে পারে না বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ মু. সিকান্দার খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ছয় বছরেও শিক্ষক নিয়োগ না দেওয়ার বিষয়টি অবিশ্বাস্য। শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর রয়েছে। তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে কি না সন্দেহ হয়। বছরের পর বছর শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছেন, অথচ একজন শিক্ষক নেই। আবার কোনোটিতে একজন বা দুজন শিক্ষক। এভাবে চলতে পারে না।