দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে সরকার আইনের আশ্রয় নেয়

দমনপীড়নের সময়ে সঠিক সাংবাদিকতা বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) নিউ এইজের সম্পাদক নূরুল কবীর, দ্য ওয়ায়র্ সম্পাদক সিদ্ধার্থ ভরদারাজন,  আলোকচিত্রী শহিদুল আলম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন। শুক্রবার রাজধানীর পান্থপথের দৃকপাঠ ভবনেছবি: আশরাফুল আলম

গণতন্ত্রহীন পরিবেশে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের ওপর নতুন ধরনের দমনপীড়ন লক্ষ করা যাচ্ছে। একজন গণতন্ত্রমনা সাংবাদিকের পক্ষেই সম্ভব দুঃসময়ে গণতন্ত্রের জন্য সঠিক সাংবাদিকতা করা। যেখানেই, যে দেশেই সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার ওপর আঘাত আসুক না কেন, সাংবাকিদকদের উচিত শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি অবলম্বন করা।

আজ শুক্রবার রাজধানীর দৃকপাঠ ভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভারত ও বাংলাদেশের দুজন সম্পাদক এবং একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এই অভিমত ব্যক্ত করেন। দমনপীড়নের সময় সঠিক সাংবাদিকতাবিষয়ক এই আলোচনার আয়োজন করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দৃক। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সমাজকর্মী উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানের মূল আলোচক নয়া দিল্লিভিত্তিক অনলাইন সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়ার–এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সিদ্ধার্থ ভরদারাজন ভারতের বর্তমান সরকার ও শাসক দল বিজেপির সমালোচনা করে বলেন, ভারতে গণতন্ত্রের মানের অবনমন ঘটেছে। গণতন্ত্রহীন অবস্থায় চাপে থাকে গণমাধ্যম, গণমাধ্যমকর্মী। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন দমনে সরকার অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে। ভিন্নমত দমনের এটি একটি উদাহরণ। এ ছাড়া সরকার মানবাধিকার রক্ষায় যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের নানাভাবে হেনস্তা করছে, ছাত্র আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করছে, কেউ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাজের সমালোচনা করলে সেই ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের কাজে সরকার বাধা দিচ্ছে। সংখ্যালঘুদের অধিকার, বিশেষ করে মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের অধিকার নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের কাজে বাধা দিচ্ছে। তাঁদের সবার পক্ষে কথা বলে গণমাধ্যম, সাংবাদিক। তাই সরকার গণমাধ্যম ও সাংবাদিককে চাপে রাখতে চায়।

ভারতের বিখ্যাত সংবাদপত্র দ্য হিন্দুর সম্পাদক ছিলেন সিদ্ধার্থ ভরদারাজন। তাঁর উপলব্ধি, ভারত সরকার ও শাসক দল গণমাধ্যম বিশেষ করে অনলাইন নিয়ন্ত্রণ বা দমনে চারটি কৌশল বেছে নিয়েছে। প্রথম কৌশল অর্থনৈতিক চাপ। সরকারের কথা শোনে না বা সরকারের পক্ষে কথা বলে না, এসব প্রতিষ্ঠানকে সরকারি বিজ্ঞাপন দেয় না। এটা পুরোনো কৌশল। এখন বেসরকারি বিজ্ঞাপন দাতাদের চাপ দেয় বিজ্ঞাপন না দেওয়ার জন্য। তৃতীয়ত, তদন্তকারী বিভিন্ন সংস্থাকে এসব গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক তদন্তে লাগিয়ে দেয়।

দমন–পীড়নের দ্বিতীয় হাতিয়ার হিসেবে সরকার আইনের আশ্রয় নেয়। আগেও নিত। কিন্তু সরকার এখন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইন ব্যবহার করছে। কোন খবর ঠিক বা বেঠিক তা বলবে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান—এমন ভাবে আইন ব্যবহার করা হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের অপব্যবহারের একাধিক উদাহরণ তিনি দেন।

সিদ্ধার্থ ভরদারাজন বলেন, তৃতীয় অস্ত্র হিসেবে সরকার ব্যবহার করছে ভুল, মিথ্যা বা বানোয়াট সংবাদ। সরকারের বিপক্ষে যায়, এমন সংবাদকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য সরকারি দলের শত শত কর্মী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন মিথা তথ্য বা সংবাদ নিয়ে। এটি সরকারি কাজের অংশ হয়ে উঠেছে। চতুর্থত, সরকার সংবাদের আধেয় নিয়ন্ত্রণ করছে। কোনো সংবাদ যেন বেশি মানুষের কাছে না পৌঁছায়, তার জন্য সরকার নানা কূটকৌশল করছে।

সাম্প্রতিককালে ভারতের সাংবাদিকদের ওপর ঘটে যাওয়া অনেক নিপীড়নমূল ঘটনা তুলে ধরেন সিদ্ধার্থ ভরদারাজন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এমন দমন–পীড়নমূলক পরিবেশে সাংবাদিক কাজ করবেন কীভাবে, তাঁদের কৌশল কী হবে? তিনি বলেন, পাঁচটি কৌশল হাতে নেওয়া যেতে পারে। ১. প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বাধীনতা থাকতে হবে। অর্থের জন্য কারও ওপর নির্ভরশীল থাকা যাবে না। ২. পাঠকের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের যুক্ততা বাড়াতে হবে। সংবাদ দেওয়ার বাইরে আরও নানা পন্থায় তাঁকে যুক্ত করতে হবে। ৩. রিপোর্টিংয়ের মান ভালো হতে হবে। রিপোর্টে ভুল থাকবে না এটা নিশ্চিত করতে হবে। ৪. সংবাদ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে, আকর্ষণীয় করে পরিবেশন করতে হবে। ইনফোগ্রাফ, চার্ট, টেবিল সংবাদে ব্যবহার করতে হবে। এসবের অভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন চোখের আড়ালে চলে যায়। ৫. সাংবাদিকদের মধ্যে সংহতি দৃঢ় করতে হবে। যেখানে, যে দেশেই সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার ওপর আঘাত আসুক না কেন, সাংবাদিকদের উচিত শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি অবলম্বন করা।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন দৃকের প্রতিষ্ঠাতা আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। অনুষ্ঠানের শুরুতে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের হামলায় নিহত এবং ঢাকার বেইলি রোডে আগুনে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

আলোচনায় অংশ নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে দেশ যাচ্ছে, সেখানে আদর্শ সাংবাদিকতা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সুরক্ষায় কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেই। ভারতে দ্য ওয়ার যা করতে পারে, তা করার কল্পনাও বাংলাদেশে সম্ভব না।

শেষ নির্ধারিত বক্তা ছিলেন ইংরেজি দৈনিক দ্য নিউ এজ–এর সম্পাদক নূরুল কবীর। তিনি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের পরিস্থিতির কিছু ক্ষেত্রে মিল আছে। রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ‘ব্র্যান্ডিং’ করা হচ্ছে। এই ভয়ে সাংবাদিকেরা নিজেরাই সংবাদ চেপে যান। তিনি বলেন, মানসম্মত জনবলের সংকটে ভুগছে দেশের গণমাধ্যম। কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিষয়ে সঠিক প্রশ্নটি করার মতো জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন সাংবাদিক কম দেখা যায়।

অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে দর্শক–শ্রোতাদের বেশ কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দেন এই তিন আলোচক।