‘চরিত্র তো চরিত্রই, কিন্তু এখন আমি পুরো বিরক্ত’

অভিনয়শিল্পী মেহেরান সানজানাছবি: সংগৃহীত

মেহেরান সানজানা পেশায় অভিনয়শিল্পী। ‘কাইজার’ নামে একটি ওয়েব সিরিজে অভিনয় করে আলোচিত হয়েছেন তিনি। চরিত্রটি ছিল একজন গৃহকর্মীর। কিন্তু গৃহকর্মীর চরিত্রে অভিনয় করে সাড়া ফেললেও মেহেরান সানজানা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি আর কখনোই গৃহকর্মীর চরিত্রে অভিনয় করবেন না।

কিন্তু কেন এমন সিদ্ধান্ত? গত ১৮ ফেব্রুয়ারি এ নিয়ে নিজের ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন সানজানা। জানিয়েছেন, গৃহকর্মীর চরিত্রে অভিনয় করার কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই। কিন্তু এরপরও অভিনয়ের যেসব প্রস্তাব পাচ্ছেন, তার সবই গৃহকর্মীর চরিত্রে। এমনকি বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনের জন্যও এমন চরিত্রে তাঁকে ডাকা হচ্ছে।

তাই তো অভিনয়শিল্পী সানাজানা বললেন, ‘কালো বলেই আমাকে কি শুধু গৃহকর্মীর চরিত্রে অভিনয় করতে হবে?’

‘কাইজার’–এ গৃহকর্মীর চরিত্রে অভিনয়দক্ষতা দেখানোর পর থেকে এ সমস্যা প্রকট হয়েছে বলে মনে করছেন সানজানা। তিনি বলেন, ‘ফেসবুকে জানিয়ে দিয়েছি, কেউ যাতে আমাকে গৃহকর্মীর চরিত্রে অভিনয়ের জন্য না ডাকেন। তারপরও যেসব কাজের জন্য ডাক পেয়েছি, তা ওই গৃহকর্মীর চরিত্রে।’

ফেসবুক পোস্টে নিজের হতাশার কথা জানিয়েছেন মেহেরান সানজানা
ছবি: সানজানার পোস্টের স্ক্রিনশট

আলাপে সানাজানাকে পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, গৃহকর্মীর চরিত্রে হয়তো আপনি খুব ভালো অভিনয় করেছেন। তাই হয়তো এ চরিত্রের জন্য ডাক পাচ্ছেন। জবাবে সানজানা বলেন, ‘তা–ও হতে পারে। আমার মনে হয়, আমার ত্বকের রং কালো বলেই এ চরিত্রের জন্য ডাক পাচ্ছি।’

সানজানা আরও বলেন, ‘এটা নিয়ে আমি খুব বিরক্ত হয়েছি। আমাকে অন্য চরিত্রের জন্য কেউ ভাবতেই পারছেন না। অথচ অনেক ফরসা অভিনেত্রীকে মেকআপ দিয়ে কালো বানিয়ে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করানো হচ্ছে। অভিনয়শিল্পী হিসেবে অন্য চরিত্রেও তো আমাকে অভিনয় করতে হবে। সে সুযোগটা তো পেতে হবে।’

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মেহেরান সানজানা তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘প্রতিটা চরিত্র আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। চরিত্র তো চরিত্রই। কিন্তু এখন আমি পুরো বিরক্ত। একই চরিত্র বারবার আমাকে দিয়ে করানো হচ্ছে। আমি নিজেকে অন্য চরিত্রে নিতে পারছি না। নিজেকে ভাঙতে পারছি না অথবা ভাঙতে দেওয়া হচ্ছে না।...আমি শুধু গৃহকর্মী চরিত্র ডিজার্ভ করি না।’

একই পোস্টে সানজানা জানান, অন্য চরিত্রে যদি কেউ কাজ না দেন, তবু গৃহকর্মীর চরিত্রে আর কাজ করবেন না। তিনি লিখেছেন, ‘কালো বলেই গৃহকর্মী চরিত্র দেবেন, এমন মানসিকতা বদলান।’

প্রায় দেড় দশক ধরে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত মেহেরান সানজানা। নাটক, ওয়েব সিরিজ ও সিনেমায় অভিনয় করেছেন। সব্যসাচী নামে একটি প্রকাশনা সংস্থার প্রকাশক তিনি।

ওয়েব সিরিজ ‘কোথায় পালাবে বলো রূপবান’-এ নার্স এবং ‘গুটি’-তে মাদক ব্যবসায়ীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন সানজানা। চলচ্চিত্র ‘সুড়ঙ্গ’-তে ভাবি, ‘নয়া মানুষ’-এ গ্রাম্য চিকিৎসকের স্ত্রী, ‘দাওয়াল’-এ বোন এবং ‘মস্ত বড়লোক’ সিনেমায় গৃহকর্মীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

সানজানা জানালেন, মঞ্চের বাইরে তাঁর অভিনয় করার তেমন ইচ্ছা ছিল না। দুই বছর আগে হুট করে একটি বিজ্ঞাপনে পিঠা বিক্রেতার চরিত্রে অভিনয়ের ডাক পান। তারপর কাজের শুরু। হাসতে হাসতে বললেন, ‘গরিবের বউ, পিঠা বিক্রেতা—এসবের বাইরে কেন যেন কেউ আমাকে ভাবতে পারেন না।’

মেহেরান সানজানা
ছবি: সংগৃহীত

সানজানা বিয়ে করেছেন শিল্পী শতাব্দী ভবকে। শতাব্দী গান লেখেন। নিজেই সুর করেন। এ দম্পতির তিন ছেলে। তারা নবম, অষ্টম ও পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে। সানজানার মা, বাবা ও একমাত্র বড় বোন মারা গেছেন।

গায়ের রং নিয়ে সানজানা বলেন, ‘আমি উজ্জ্বল শ্যামলা নই, আমি কালো। এ রঙের জন্য পদে পদে আমাকে হেনস্তা হতে হয়েছে, এখনো হতে হয়। আগে বাসায় কেউ বেড়াতে এলে ভাবতেন, আমি বাসার গৃহকর্মী। বন্ধুদের আড্ডায় নানা মন্তব্য শুনতে হয়েছে। আমার কালো পোশাক খুব পছন্দের। কালো পোশাক কিনতে গেলে বিক্রেতাও বলেন, “আফা, আপনে অন্য কালারেরটা দেখেন। কালো মেয়েদের কালো পোশাক মানায় না।”’

সানজানার মায়ের গায়ের রং কালো ছিল। এ কথা জানিয়ে সানজানা বলেন, ‘২২ বছর আগে মা মারা গেছেন। মা সব সময় বলতেন, অন্যের জন্য নিজেকে পাল্টানোর কোনো প্রয়োজন নেই। কালো রং দেখে কেউ পছন্দ করলে করবে, নয়তো নয়। একটা সময়ে এসে মায়ের এ কথা মানতে পেরেছিলাম। এর আগে পর্যন্ত পাউডার মেখে মেখে নিজেকে ফরসা দেখানোর চেষ্টা করতাম।’

সানজানা আরও বলেন, ‘আমি চাই, দর্শকেরা আমার কালো চেহারা নয়, আমার কাজ দিয়েই আমাকে চিনুক। সে জন্য বিভিন্ন চরিত্রে কাজ করার সুযোগ পেতে হবে। সুযোগ পেলে আমি আমার অভিনয়দক্ষতা দেখানোর সুযোগ পাব। কিন্তু ঘুরেফিরে এক গৃহকর্মীর চরিত্রে অভিনয় করে বা শুধু এ চরিত্রের জন্য ডাক পেতে পেতে এখন আমি খুব বিরক্ত।’