এক সংগ্রামী জুলফিকারের অধরা স্বপ্ন
পদে পদে ছিল তাঁর প্রতিবন্ধকতা। বড় সংগ্রাম করে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছিলেন জুলফিকার আহমেদ শাকিল। স্বপ্ন ছিল শিল্পী হবেন। কিন্তু আরও এক বড় সংগ্রামে অংশ নিয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সে জীবনের চিত্রপট থেকে সরে গেলেন এই তরতাজা তরুণ।
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে প্রথম থেকেই সক্রিয় ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের (ইউডা) চারুকলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জুলফিকার আহমেদ। এ আন্দোলন ক্রমে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনে পরিণত হয়। ৪ আগস্ট মিরপুর এলাকায় মিছিলে নেমেছিলেন এই তরুণ। দুপুর তখন সাড়ে ১২টা প্রায়। তাঁদের মিছিলে পুলিশ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা হামলা চালায়। মাথায় গুলি লেগেছিল জুলফিকারের। সঙ্গীরা তাঁকে গুরুতর আহত অবস্থায় আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে ভর্তি করেন। গতকাল বুধবার বেলা তিনটায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হয়েছিল জুলফিকার আহমেদের মরদেহ। ব্যবস্থা করেছিল বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন। জুলফিকার ছিলেন এই সংগঠনের ঢাকা মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক। এখানে গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষে সাইফুল হক, জোনায়েদ সাকি, শহীদ উদ্দিন মাহমুদ, হাসনাত কাইয়মুসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, শ্রমিক ও ছাত্রসংগঠনের পক্ষ থেকে এবং ব্যক্তিগতভাবে অনেক বন্ধু শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সঞ্চালনা করেন ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ।
পরিবারের পক্ষ থেকে এসেছিলেন জুলফিকার আহমেদের মামা মো. শহীদুল ইসলাম। তিনি জানালেন, জুলফিকারের কঠিন জীবনসংগ্রামের কাহিনি। তাঁর বাবা সিদ্দিক হোসেন ছিলেন জেলে। কিশোর বয়সেই জুলফিকার বাবাকে হারান। তাঁর বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। বাবার মৃত্যুর পর ছোট এক ভাই ও মা আয়েশা বেগমকে নিয়ে কঠিন বিপদে পড়েন। জুলফিকার পড়ালেখায় ভালো ছিলেন। মামা শহীদুল ঢাকার মিরপুরে ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ করেন। ভাগনেকে তিনি ঢাকায় নিয়ে আসেন। ভর্তি করে দেন মিরপুরে ‘পাঠশালা’ নামে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্কুলে। এই স্কুলে পড়ার পাশাপাশি নানা রকমের কাজ করে বড় হতে থাকেন তিনি। ভালো ছবি আঁকতেন জুলফিকার। সংগঠকের গুণও ছিল তাঁর মধ্যে। স্বপ্ন দেখতেন একদিন বড় শিল্পী হবেন। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ইউডাতে ভর্তি হয়েছিলেন চারুকলা বিভাগে।
জুলফিকারের বাড়ি ভোলা সদর উপজেলার বাগমারা গ্রামে। তাঁর মামা জানান, বেশ কয়েক বছর হলো মাকে ঢাকায় নিয়ে এসে মিরপুর ১২ নম্বরের মুসলিমবাজার এলাকায় একটি ঘর ভাড়া করে থাকছিলেন জুলফিকার। টিউশনি ও আঁকাজোকার কাজ করে মা-ছেলের সংসার চলত। তাঁর ছোট ভাই সুমন হোসেন পড়ালেখা করতে পারেনি। গ্রামেই একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করে। ছেলের মৃত্যুতে মা আয়েশা বেগম পাগলের মতো হয়ে গেছেন। গ্রামেই জুলফিকারকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হবে বলে তাঁর মামা জানালেন।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পরে বন্ধু, সহপাঠী, পাঠশালা স্কুলের শিক্ষক আর ছাত্ররাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার ফুলে ফুলে ঢাকা জুলফিকারের কফিনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে নিয়ে আসেন। সেখানে বাদ জোহর জানাজা হয়।
জুলফিকারের শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলো না। কিন্তু যে বৈষম্যহীন সমাজ, গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আত্মোৎসর্গ করে গেলেন আরও অনেকের মতো—তাঁদের সেই আত্মনিবেদনের মর্যাদা রাখবে এই দেশ, এই দেশের মানুষ?