ভালোবাসা দিয়ে পথ দেখালে তরুণেরা পথ হারাবে না

মাদকাসক্তের কারণে অনেকে কটু কথা বললেও ভালো করার জন্য কেউ পথ দেখাত না। অবশেষে ব্র্যাকের আরএইচআরএন প্রকল্প শাজিম ইসলামকে দেখিয়েছে সেই পথছবি: খোরশেদ আলম

দৃঢ় মনোবল আর প্রচেষ্টা থাকলে কোনো বাধা পেরোনোই কঠিন নয়। দরকার ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস আর কঠোর পরিশ্রম। আমাদের আশপাশে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিজেদের জীবনগাথায় লিখে চলেছেন অদম্য জয়ের গল্প। তাঁদের সেই সাফল্য ব্যক্তিগত অর্জনের সীমানা পেরিয়ে সমাজের নানাবিধ প্রতিবন্ধকতাকেও চ্যালেঞ্জ করেছে। তেমনই কয়েকজনের গল্প নিয়ে ধারাবাহিক এ আয়োজন। আজ জানব রংপুর সদরের খলেয়া ইউনিয়নের দেওরা গ্রামের বানিয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা শাজিম ইসলামের জীবন-গল্প। (শুরুতেই একসার্পট আকারে যাবে)

রংপুর সদরের খলেয়া ইউনিয়নের অন্তর্গত গ্রাম দেওরা। এই গ্রামের বানিয়াপাড়ায় এক সাধারণ পরিবারে আমার জন্ম। আমি শাজিম ইসলাম। আমার তারুণ্য ছিল অন্ধকারে ঢাকা। ২০ বছর বয়সে সঙ্গদোষে নেশার কবলে পড়ি। নেশার ঘোরে চারপাশের সবাইকে তুচ্ছ ভাবতাম, অবহেলা করতাম। বিশেষ করে আমার বয়সী কারও সঙ্গে বনিবনা হতো না। সব সময় মেজাজ খিটখিটে থাকত। সবার সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করতাম। রগচটা আর বদমেজাজের কারণে সবাই আমাকে ভয় পেত। পরিচিতরা এড়িয়ে চলায় নিজেকে খুব বদ্ধ জগতের মানুষ মনে হতো। এই জগৎ থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

নেশায় আসক্ত থাকায় লেখাপড়াও বেশি দূর এগোতে পারিনি। পরিবারের কেউ আমার ওপর ভরসা করতে পারত না। ঘরে-বাইরে মানুষের এত অসম্মান আমাকে অনেক পীড়া দিচ্ছিল। তখন লক্ষ করলাম, আমার স্বভাবের কারণে অনেকেই কটু কথা বললেও অন্ধকার থেকে আলোতে আনার পথ দেখাত না। আর নেশার ঘোরে আমার রাত-দিন পার হতে থাকে।

এর মধ্যে আমার ছোট বোনের বিয়ে হয়, যদিও তার বয়স কম ছিল। পরিবারের সবাই ভেবেছিল বোন অনেক সুখী হবে। কিন্তু তা হলো না। তার কষ্ট দেখে আমার উপলব্ধি হয়, অধিকাংশ পুরুষ নারীদের মর্যাদা দেয় না। নারীর জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। বোনের সংসারজীবনের কষ্ট আমাকে ভাবনায় ফেলে।

নিজেকে বদলানোর সুযোগ খুঁজি। একদিন খবর পাই আমাদের গ্রামে ব্র্যাকের একটি প্রকল্প আছে, যেখানে আমার বয়সী ছেলেমেয়েরা যায়। নিয়মিত বৈঠক করে। ‘অধিকার এখানে, এখনই’ (আরএইচআরএন) নামে তরুণদের গ্রুপে লিঙ্গসমতা, অধিকার আর আবেগ বা রাগ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথা বলা হয়।

প্রথমে এ ধরনের প্রকল্পের কথা শুনে হাসতাম। বন্ধুদের সঙ্গে হাসি-তামাশাও করেছি। তবে একদিন কৌতূহলবশত আরএইচআরএনের ওই সেশনে যাই। এরপর মনে হলো, অন্ধকারে বসবাস করা আমি আলোর দেখা পেয়েছি। বৈঠকগুলোতে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। বুঝলাম, আমি ভালোবাসা আর সম্মানের কাঙাল ছিলাম। তাদের কথা শুনে ভেতরে ভেতরে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। নতুন করে অন্ধকার থেকে আলোর পথের দিশা পাই।

সেই প্রকল্প থেকে ইলেকট্রিক্যাল আর হাউস ওয়্যারিংবিষয়ক প্রশিক্ষণ নিই। এরপর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিভিন্ন বাসাবাড়ি এবং নির্মাণাধীন ভবনে কাজ শুরু করি। যেকোনো ইলেকট্রিক্যাল কাজের সমাধান করতে শিখি। ফ্যান, মোটর, রাইস কুকার মেরামত কিংবা ওয়্যারিং কাজে আমার দক্ষতার কথা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। আমার ব্যবহারেও অনেক পরিবর্তন আসে। মানুষকে সম্মান আর সমীহ করে কথা বলতে শিখি। বিনিময়ে হারানো ভালোবাসা আর সম্মান ফিরে পাই।

বৈদ্যুতিক কাজের প্রশিক্ষণ নিয়ে মূলধারায় ফেরেন শাজিম। ধীরে ধীরে হারানো সম্মান ও ভালোবাসার দেখা পান
ছবি: খোরশেদ আলম

মাদক গ্রহণের সময় আনন্দে বাঁচার মতো জীবনের কোনো সন্ধান পাইনি। নিজের বদলের পর বুঝতে পারি, জীবন অনেক সুন্দর। আমি একসময় শুধু নিজের জীবন ধ্বংস করিনি, অন্যদের জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছি। তাই এখন নিজের কাজের পাশাপাশি তরুণদের উৎসাহ দিই, জীবনে শৃঙ্খলার গুরুত্বের কথা বলি, তাদের আমার পরিবর্তনের গল্প বলি।

অনেক তরুণ আসলে সঠিক পথের দেখা পায় না। ভালোবাসা দিয়ে পথ দেখালে তরুণেরা পথ হারাবে না। আমি পথ হারানো অনেক তরুণকে পথ দেখিয়েছি। তরুণদের দায়িত্ববান হতে বলি। কারণ, জীবনে শৃঙ্খলার কোনো বিকল্প নেই। বয়সকালে অনেক এলোমেলো চিন্তা হয়, কিন্তু এগুলো ক্ষণিকের।

আমার বোনের বাল্যবিবাহ নিয়ে আমার যে তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে, সেটাকে বিবেচনায় নিয়ে আমি অনেক প্রতিরোধমূলক কাজ করেছি। আর কোনো বোনের জীবন যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য কাজ করছি। ধীরে ধীরে সবাই আমার ওপর আস্থা রাখতে থাকেন। আগে আমাকে দেখলে যাঁরা অবহেলা করতেন, তাঁরাই বুকে জড়িয়ে ধরেন। আমি এই ভালোবাসা আর সম্মান হারাতে চাই না।

আপনাদের আশপাশে বা পরিবারে যদি কেউ মাদকাসক্ত হয়, তাকে অবহেলা করবেন না। দূরে ঠেলে দেবেন না। তার জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিন। পরিবর্তনের পথ দেখান। নিশ্চিত করে বলতে পারি, সে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।