ফ্যাটি লিভার নিয়ন্ত্রণে না আনলে অচিরেই হুমকি হয়ে উঠতে পারে

বাংলাদেশ হেপাটোলজি সোসাইটি আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় বক্তব্য দেন দেশের বিশিষ্ট লিভার বিশেষজ্ঞরা। সিরডাপ মিলনায়তন, ঢাকা, ৭ জুন
ছবি: প্রথম আলো

দেশের জনসংখ্যার ৩৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ, অর্থাৎ গড়ে তিনজনের একজন ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। এই সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি। এর মধ্যে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর (৩০ থেকে ৪০ বছর) সংখ্যাই বেশি। যাঁদের আক্রান্তের হার ৩০ শতাংশ। অপর দিকে ৪০ থেকে ৬০ বছরের বেশি বয়সী ২৫ শতাংশ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। এসব রোগী একবার করে চিকিৎসকের কাছে গেলেও বছরে চিকিৎসা ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৫ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা, যা জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের মোট বরাদ্দের দ্বিগুণ। তবে দেশের লিভার চিকিৎসার বিশেষজ্ঞরা আশার কথা শুনিয়ে বলেছেন, এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন এই রোগ প্রতিরোধের মূলমন্ত্র।

বুধবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ হেপাটোলজি সোসাইটি আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় লিভার রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা এসব তথ্য জানান। ‘নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়াটোহেপাটাইটিস’ (ন্যাশ) দিবস উপলক্ষে এ আলোচনার আয়োজন করা হয়। জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রতিবছর ৮ জুন সারা বিশ্বে ন্যাশ দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশেও ২০১৮ সাল থেকে জুন মাসে দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ উপলক্ষে বুধবার (৭ জুন) ‘ফ্যাটি লিভার: বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক বোঝা’ শীর্ষক এই গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করা হয়।

আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) অধ্যাপক এ এস এম মতিউর রহমান। সভাপতিত্ব করেন দেশে লিভার চিকিৎসার পথিকৃৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও হেপাটোলজি সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক মবিন খান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হেপাটোলজি সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. শাহিনুল আলম।

‘বাংলাদেশে ফ্যাটি লিভারের প্রাদুর্ভাব’ বিষয়ে আলোচনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হেপাটোলজি বিভাগের লিভার বিশেষজ্ঞ সাইফুল ইসলাম বলেন, সাধারণভাবে ফ্যাটি লিভার বলতে লিভার বা যকৃতে চর্বি জমা বোঝায়। একটা সময় ধারণা ছিল, যাঁরা অতিরিক্ত অ্যালকোহল বা মদ্যপান করেন, তাঁরাই এতে আক্রান্ত হন। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, যাঁরা জীবনেও অ্যালকোহলজাতীয় পানীয় পান করেননি, তাঁরাও ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এটা মোকাবিলা করা সারা বিশ্বেরই চ্যালেঞ্জ। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশেই এই রোগে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি। ফ্যাটি লিভার দ্বিতীয় ধাপে ন্যাশে রূপান্তরিত হয়। এর পরের ধাপ লিভার সিরোসিস এবং পরের ধাপে অনেকে লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হন। অচিরেই এই রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা না হলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

‘ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধে করণীয়’ বিষয়ে আলোচনা করেন বিএসএমএমইউর হেপাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, ফ্যাটি লিভার হলেই আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই। প্রাথমিক পর্যায়ে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ জন্য জীবনধারা ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। ফাস্ট ফুড, জাঙ্ক ফুড, কোমল পানীয়, অতিরিক্ত তেল-চর্বিজাতীয় খাবার, গরু-ছাগলের মাংস—এসব পরিহার করতে বা কম খেতে হবে। আর কায়িক পরিশ্রমের পরিমাণ বাড়াতে হবে। দিনে ন্যূনতম ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে ৫ দিন হাঁটতে ও ব্যায়াম করতে হবে। একটানা বসে কোনো কাজ না করা, ওজন কমানো, পাশাপাশি অন্য রোগ, যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস—এসব নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং চিকিৎসকের পরামর্শমতো চললে ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধ করে সুস্থ থাকা যায়।

মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক শাহিনুল আলম তাঁর নেতৃত্বে হেপাটোলজি সোসাইটির পক্ষ থেকে পরিচালিত এক জরিপের আলোকে এই রোগের চিকিৎসা ব্যয় তথা এর আর্থিক মূল্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত একজন রোগী একবার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিতে এলে রোগ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। এর সঙ্গে চিকিৎসকের খরচ, ওষুধের খরচ ও যাতায়াত খরচ—সব মিলিয়ে মোট খরচ দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৮১০ টাকা। এই হিসাবে সব রোগী চিকিৎসকের কাছে এলে খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৫ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা।

অধ্যাপক শাহিনুল আলম বলেন, ফ্যাটি লিভারের প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসার পর নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শে থাকা, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধরার পরিবর্তন করলে এটা প্রতিরোধ করা যায়। নয়তো পরবর্তী সময়ে রোগটি ন্যাশ এবং সিরোসিস বা ক্যানসারে পরিণত হলে চিকিৎসার জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ হতে থাকে। কাজেই রোগটি যেহেতু প্রতিরোধযোগ্য, তাই প্রাথমিক পর্যায়েই তাকে প্রতিরোধ করা সবচেয়ে ভালো।

এ জন্য ১০টি সুপারিশ করেছেন এই লিভার বিশেষজ্ঞ। এর মধ্যে রয়েছে হাঁটা, সাইকেল চালানো, সাঁতার, দড়িলাফ করা, প্রক্রিয়াজাত খাবার ত্যাগ করা। পাশাপাশি নীতিনির্ধারক পর্যায়ে এলাকায় নাগরিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সবুজায়ন, হাঁটার ব্যবস্থা রাখা, সড়কে বাইসাইকেলের লেন করা, স্কুলে খেলার মাঠ রাখা বাধ্যতামূলক করা এবং জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য ব্যাপক প্রচারাভিযান চালানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

প্রধান অতিথি অধ্যাপক এ এস এম মতিউর রহমান তাঁর আলোচনায় ন্যাশ প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, ন্যাশ প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য পুরো জাতিকে একত্র করতে হবে। চিকিৎসক, জনপ্রতিনিধি, সমাজসেবক, সরকারি-বেসরকারি কর্মী, গণমাধ্যম এবং বিশেষভাবে ধর্মীয় নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক মবিন খান বলেন, পুরো পৃথিবীতেই ন্যাশ খুব দ্রুতগতিতে বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে এ দেশেও ফ্যাটি লিভার রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। সাড়ে চার কোটি আক্রান্ত রোগীর মধ্যে এক কোটি লিভার সিরোসিস ও ক্যানসারের ঝুঁকিতে রয়েছেন। এই বিপুলসংখ্যক রোগী চিকিৎসক ও হাসপাতালে যে খরচ করছেন, তা সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির জন্যই একটি বিরাট বোঝা। এ জন্য ফ্যাটি লিভার উপশমে ব্যবস্থা নেওয়া প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব। এ জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালতে হবে। নিজে সুস্থ থাকার পাশাপাশি এই বিপুল ব্যয়ের বোঝা থেকে অর্থনীতিকেও রক্ষা করতে হবে।

আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড অ্যান্ড মাদারের প্রধান পুষ্টিবিদ শায়লা নাসরিন। সূচনা বক্তব্য দেন বারডেমের সহযোগী অধ্যাপক গোলাম আযম। ন্যাশ দিবস উপলক্ষে সভায় ভিডিও বার্তা দিয়েছেন গ্লোবাল লিভার ইনস্টিটিউটের সিইও এবং প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট ডোনা ক্রাইয়ার। আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা আবু হেনা আবিদ জাফর, হেপাটোলজি সোসাইটির ভারপ্রাপ্ত সহসভাপতি মোতাহার হোসেন, কিশোরগঞ্জের শহীদ নজরুল মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক এস কে এম নাজমুল হাসান, স্কয়ার হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এস কে বাহার হোসেন, ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, বাংলাদেশ অ্যাকাউন্টিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক এম হারুন উর রশিদ ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আমির খসরু।