নজরের বাইরে থাকা চৈতী দেশের জন্য আনল স্বর্ণপদক

দুবাইয়ে চলমান এশিয়ান ইয়ুথ প্যারা গেমসে চৈতী দুটি স্বর্ণপদক জিতেছেছবি: শি–এর সৌজন্যে

একটু বড় হওয়ার পর মেয়েকে দেখে চিন্তায় পড়ে যান মা–বাবা। অন্য শিশুদের মতো বাড়ছে না সে। হাত–পা ছোট, উচ্চতাও থমকে গেছে। পরে বুঝতে পারেন—চৈতী বামন।

যে মেয়েকে নিয়ে একসময় দুশ্চিন্তার পাহাড়ে আটকা পড়েছিল পরিবার, আজ সেই চৈতীই আনন্দের আলো ছড়াচ্ছে। দেশের জন্য প্রথমবারের মতো এশিয়ান ইয়ুথ প্যারা গেমসে স্বর্ণপদক এনে দিয়েছে চৈতী রানী দেব।

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভূনবীর গ্রামের শিলু রানী দেব ও সত্য দেবের মেয়ে চৈতীর বয়স ১৩ বছর। উচ্চতা মাত্র ৩ ফুট ৭ ইঞ্চি। কিন্তু তার লক্ষ্য নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া । সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে চলমান এশিয়ান ইয়ুথ প্যারা গেমস ২০২৫–এ বর্শা নিক্ষেপ ও ১০০ মিটার দৌড়ে সে জিতে নিয়েছে দুটি স্বর্ণপদক। ৭ ডিসেম্বর এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, চলবে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

চৈতীর প্রতিভা আছে। অনুশীলনে সে খুব আন্তরিক। সে কিছু করতে চায়। আশা করছি, ওকে দিয়ে একটা ভালো ফলাফল পাব
মেহেদী হাসান, বিকেএসপির প্রধান প্রশিক্ষক

চৈতীর স্বর্ণপদক পাওয়ার বিষয়টি দুবাই থেকে প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্সের (শি) প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী শারমিন ফারহানা চৌধুরী।

যে মেয়েকে সবাই দেখত শুধু উচ্চতায়

ভূনবীর দশরথ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী চৈতী একসময় গ্রামবাসীর নজরে পড়ত শুধু তার খর্বাকৃতির জন্য। খেলাধুলায় তার যে অসাধারণ প্রতিভা আছে, তা ছিল চোখের আড়ালে।

তবে এই ছবি এখন বদলে গেছে। গ্রামবাসী বাড়িতে এসে খোঁজ নেন। শিক্ষকেরা খেলতে উৎসাহ দেন, ছবি তোলেন। স্কুলে সে এখন ‘তারকা’।

দুবাইয়ে বর্শা নিক্ষেপে স্বর্ণপদক জয়ের পর চৈতী
ছবি: শি-এর সৌজন্যে

এমন পরিবর্তন দেখে মন ভরে ওঠে মা শিলু রানী দেব আর বাবা সত্য দেবের। সত্য দেব কৃষিকাজ করেন, পাশাপাশি ডেকোরেশনের সরঞ্জাম ভাড়া দেন। চার বোনের মধ্যে চৈতী সবার ছোট। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। বড় বোন স্নাতকোত্তরের ছাত্রী। মেজ বোন উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন আর সেজ বোন স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ছাত্রী।

বিকেএসপির মাঠে প্রস্তুতি

গত মাসে চৈতীর মায়ের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি জানান, দুবাই যাওয়ার আগে চৈতী এক মাস প্রশিক্ষণ নেয় সাভারের বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি)।

গত ২৭ নভেম্বর বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের ট্র্যাকে দৌড়াচ্ছে চৈতী। প্রতিযোগিতার আগে নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছিল প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে।

প্রশিক্ষণের ফাঁকে চৈতী প্রথম আলোকে বলে, ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা তার ভালো লাগত। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অ্যাথলেটিকসের প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে। দুবাই থেকে সে দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনতে চায়।

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভূনবীর গ্রামের শিলু রানী দেব ও সত্য দেবের মেয়ে চৈতীর বয়স ১৩ বছর। উচ্চতা মাত্র ৩ ফুট ৭ ইঞ্চি। কিন্তু তার দৌড়ের গতি, শক্ত মনোবল আর লক্ষ্য অনেক উঁচু।

এর আগেই সে নিজের সক্ষমতার জানান দেয়। গত অক্টোবরে আয়োজিত ন্যাশনাল ইয়ুথ প্যারা গেমসে ১০০ মিটার দৌড়ে চ্যাম্পিয়ন হয় চৈতী। শারীরিক প্রতিবন্ধী তরুণ খেলোয়াড়দের নিয়ে এই বার্ষিক জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করে জাতীয় প্যারালিম্পিক কমিটি (এনপিসি)।

চৈতী বলেছিল, নিজেকে প্রস্তত করার জন্য সে অনেক পরিশ্রম করছে। বাবা-মা ও পরিবারের সদস্য ছাড়াও শিক্ষক, গ্রামবাসীরাও তাকে উৎসাহ জুগিয়েছে।

‘চৈতী কিছু করতে চায়’

বিকেএসপির প্রধান প্রশিক্ষক মেহেদী হাসান বলেন, ‘চৈতীর প্রতিভা আছে। অনুশীলনে সে খুব আন্তরিক। সে কিছু করতে চায়। আশা করছি, ওকে দিয়ে একটা ভালো ফলাফল পাব।’

মেহেদী হাসান আরও বলেন, অনুশীলনের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের সংকট ছিল। চৈতীর অনুশীলনের জন্য ৪০০ গ্রাম ওজনের একটি বর্শা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটি কোথাও পাওয়া যায়নি। পরে তারা একটি বর্শা প্রস্তুত করে নেন অনুশীলনের জন্য।

শি-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী শারমিন ফারহানা চৌধুরীর সঙ্গে চৈতী
ছবি: শি-এর সৌজন্যে

জাতীয় প্যারালিম্পিক কমিটির সচিব মারুফ আহমেদ মৃদুল বলেন, এশিয়ান ইয়ুথ প্যারা গেমসে বাংলাদেশ এবারই প্রথম অংশ নিয়েছে। বাংলাদেশের ২৮ জন খেলোয়াড় প্যারা অ্যাথলেটিকস, প্যারা তায়কোয়ান্দো, হুইলচেয়ার বাস্কেটবল, প্যারা টেবিল টেনিস, প্যারা সুইমিং, প্যারা ব্যাডমিন্টন, প্যারা আর্চারি ইভেন্টে অংশ নিয়েছে। প্রতিযোগীদের প্রায় এক মাস প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

শুরুতে যার নজরে পড়েছিল চৈতী

চৈতীর মা শিলু রানী দেব বলেন, তাঁর মেয়ে যে এত ভালো খেলতে পারে, সেটা তাঁর জানা ছিল না। এলাকায় স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্স (শি) নামের একটি সংগঠন ছেলেমেয়েদের বিনা মূল্যে খেলাধুলার প্রশিক্ষণ দেয়, প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। শুরুতে শি-এর সদস্যদের নজরে পড়ে চৈতী। শি প্রথম তাঁর মেয়ের প্রতিভার বিষয়টি সামনে তুলে এনেছে। সেখান থেকেই চৈতীর সুযোগ তৈরি হয়।

প্রথমে বর্শা নিক্ষেপে চৈতী স্বর্ণপদক জিতে নেয়। এটা প্যারা স্পোর্টসে বাংলাদেশের প্রথমবারের মতো পাওয়া স্বর্ণপদক। পরদিন শুক্রবার ১০০ মিটার দৌড়েও স্বর্ণপদক জিতেছে চৈতী
পাপ্পু লাল মোদক, স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্সের ক্রীড়া উন্নয়ন প্রধান

শি–এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী শারমিন ফারহানা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যখন ঠিক করি শ্রীমঙ্গলের চা–শ্রমিকদের মেয়েদের নিয়ে কাজ করব, তখন শুরুর দিকে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় খেলাধুলার একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। তখন আশপাশের স্কুলগুলোকেও দাওয়াত দেওয়া হয়। সেখানেই চৈতীকে প্রথম দেখি। আমাদের ক্রীড়া উন্নয়ন প্রধান পাপ্পু লাল মোদক চৈতীকে দেখিয়ে বলেছিলেন, এই মেয়েটাকে যদি একটু প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, তাহলে ও অনেক দূর যাবে। এরপর আমরা চৈতীর স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বললাম। আমাদের কোচ ওকে অ্যাথলেটিকসের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন।’

দুবাইয়ে চৈতীর ইতিহাস, দেশে স্বপ্ন

পাপ্পু লাল মোদক দুবাই থেকে প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমে বর্শা নিক্ষেপে চৈতী স্বর্ণপদক জিতে নেয়। এটা প্যারা স্পোর্টসে বাংলাদেশের প্রথমবারের মতো পাওয়া স্বর্ণপদক। পরদিন শুক্রবার ১০০ মিটার দৌড়েও স্বর্ণপদক জিতেছে চৈতী।

কখনো ভাবিনি মেয়ে বিদেশে গিয়ে খেলবে। আমি চাই ও খেলাধুলায় ওর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলুক। ও যেন কারও ওপর নির্ভরশীল হয়ে না থাকে। নিজের দায়িত্ব যেন নিতে পারে
শিলু রানী দেব, চৈতীর মা

পাপ্পু লাল মোদক আরও বলেন, ওই দিন ১০০ মিটার সাঁতারে মো. শহিদুল্লাহ নামের আরেক প্রতিযোগী ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইল সাঁতারে স্বর্ণ ও ৫০ মিটার সাঁতারে ব্রোঞ্জপদক জিতেছে। আর নারীদের হুইলচেয়ার বাস্কেটবল দল ব্রোঞ্জপদক জিতেছে।

চৈতীর মা বলেন, একসময় মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগতেন। ভালো চিকিৎসা করাতে না পারার আক্ষেপ ছিল। নিজেকে নিয়ে আক্ষেপ ছিল চৈতীরও। তিনি বলেন, ‘কখনো ভাবিনি মেয়ে বিদেশে গিয়ে খেলবে। আমি চাই ও খেলাধুলায় ওর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলুক। ও যেন কারও ওপর নির্ভরশীল হয়ে না থাকে। নিজের দায়িত্ব যেন নিতে পারে।’

বিকেএসপিতে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় চৈতী রানী দেব
ছবি: প্রথম আলো

শিলু রানী দেব আরও বলেন, দুবাই থেকে চৈতী প্রতিদিন ফোন করে তার আনন্দ প্রকাশ করে। ১০ ডিসেম্বর তার জন্মদিন ছিল। দুবাইয়ে তার সফরসঙ্গীরা কেক কেটে জন্মদিন উদ্‌যাপন করেছে।

চৈতী তার আরও বড় স্বপ্নের কথা জানিয়েছে। সে খেলাধুলা চালিয়ে যেতে চায়, পড়াশোনা শেষ করে একজন চিকিৎসক হতে চায়। সবার বিশ্বাস, চৈতী তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে। কারণ, খর্বাকৃতি শরীর নিয়ে যে মেয়েটিকে একসময় সবাই করুণ চোখে দেখত, আজ সেই চৈতীই প্রমাণ করছে উচ্চতা নয়, স্বপ্নই মানুষকে বড় করে।