মেয়াদ বাড়ে, কাজ শেষ হয় না

প্রকল্পগুলোতে ব্যয় হচ্ছে ১৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। তিনটির কাজ পেয়েছিল সরকারদলীয় সমর্থকদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের দ্বিতীয় ভবন। গত শুক্রবার বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ছয়তলা দ্বিতীয় ভবনের নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল সমালোচিত বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে দেওয়া কার্যাদেশ অনুযায়ী ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এ কাজের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। ওই সময়ে কাজটি শেষ হয়নি। এরপর আরও ছয় দফায় তিন বছর নয় মাস সময় বাড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরও ৭৫ কোটি টাকার কাজটি শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দ্য বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স-জেকেবিএলের (জেভি) কাজটি তদারকির দায়িত্বে আছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবুল মনসুর জামশেদ।

শুধু এই প্রকল্পে নয়, এ রকম আরও তিনটি প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। তাদের সময় বাড়ানো হয়েছে চার থেকে সাত দফা। একটি ছাড়া বাকিগুলোর কাজ পেয়েছিল সরকারদলীয় সমর্থকদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তিন থেকে ছয় বছর ধরে প্রকল্পগুলোর কাজ চলছে।

ঠিকাদারের কার্যাদেশ বাতিল করে নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া জটিল। এ ক্ষেত্রে প্রকল্পের খরচও বাড়বে। তাই নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারলেও ঠিকাদারদের সুযোগ দেওয়া হয়।
এস এম মনিরুল হাসান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার

প্রকল্পগুলোর মধ্যে আছে দুটি একাডেমিক ভবন, ছাত্রদের একটি আবাসিক হল ও প্রকৌশল দপ্তর। এই ৪ প্রকল্পের কাজে ব্যয় হচ্ছে ১৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।

নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা কিংবা প্রকল্প বাতিল করে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে। তা না করে উল্টো সময় বাড়ানো হয়েছে। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ঠিকাদারের কার্যাদেশ বাতিল করে নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া জটিল। এ ক্ষেত্রে প্রকল্পের খরচও বাড়বে। তাই নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারলেও ঠিকাদারদের সুযোগ দেওয়া হয়।

প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় শিক্ষা ও গবেষণার মান বৃদ্ধির জন্য।
মুহাম্মদ আলমগীর, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত)

শুধু সময়ই বাড়ে

গত ছয় বছরে কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের দ্বিতীয় ভবনের নির্মাণকাজ হয়েছে ৭০ শতাংশ। গত ৩০ জুন ষষ্ঠ দফার বর্ধিত মেয়াদ শেষ হয়। এরপর আর নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারা প্রসঙ্গে ঠিকাদার ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবুল মনসুর জামশেদ দাবি করেন, প্রথমে যে সময় দেওয়া হয়েছিল, তা পর্যাপ্ত ছিল না। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলার কারণে বিলও আটকে ছিল। তাই কাজ করা সম্ভব হয়নি।

গতকাল রোববার বিকেল পাঁচটার দিকে সরেজমিন কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের দ্বিতীয় ভবনে গিয়ে দেখা যায়, চারপাশে ইট ও কংক্রিটের অংশ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে। অবকাঠামো দৃশ্যমান হলেও রং করার কাজ বাকি। দেয়ালজুড়ে পড়েছে শ্যাওলার আস্তরণ। সেখানে কয়েকজন শ্রমিককে দেয়ালে পলেস্তারা দেওয়ার কাজ করতে দেখা যায়।

এ প্রকল্পের মতো সাত দফা সময় দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তর ভবনের নির্মাণকাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। ৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকার এ কাজ পেয়েছেন চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি দিদারুল আলমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রয়েল অ্যাসোসিয়েট।

তবে কাজটির সঙ্গে যুক্ত আছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম এ খালেদ চৌধুরী। ৭ দফায় ৪২ মাস সময় বাড়িয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এখনো কাজের ১০ শতাংশ বাকি। সর্বশেষ গত ৩০ জুন ৬ দফায় মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ৭ দফায় তাঁর বর্ধিত সময়ের মেয়াদ চলতি বছরের ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসনসংকট নিরসনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের জুলাই মাসে। পরে ৫ দফায় ৩ বছর দেওয়ার পরও এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি মাত্র ৬৮ শতাংশ। ২২ কোটি টাকার এ কাজ করছে ঢাকার প্রতিষ্ঠান ঢালী কনস্ট্রাকশন লিমিটেড।

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য ও পরিবহন নেতা মঞ্জুরুল আলম চৌধুরীর ভাই জাহেদুল আলম চৌধুরীও একটি প্রকল্পের ঠিকাদার। তাঁর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদ ভবনের কাজ। এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি। ৪ দফা বৃদ্ধির পরও ৩৫ কোটি টাকার এ প্রকল্পের অগ্রগতি এখনো ৯৫ শতাংশ।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় শিক্ষা ও গবেষণার মান বৃদ্ধির জন্য।

তাই সময়মতো প্রকল্পের কাজ শেষ না হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ না হলে এর দায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না। কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল ঠিকাদারদের সময়মতো কাজ শেষ করতে বাধ্য করা।