নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে নিবন্ধন পেতে যাচ্ছে সেই দুই প্রতিষ্ঠান

নির্বাচন কমিশন ভবন
ফাইল ছবি

অবশেষে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে নিবন্ধন পেতে যাচ্ছে বিতর্কিত দুই সংস্থা ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম ও সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন। এর আগে প্রথম দফায় শর্ত পূরণ না করায় তাদের আবেদন বাতিল করেছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন করে এ দুটিসহ ২৯টি দেশি প্রতিষ্ঠানকে ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা’ হিসেবে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর মধ্যে আরও কয়েকটি নামসর্বস্ব সংস্থা রয়েছে বলে জানা গেছে।

এর আগে গত সেপ্টেম্বরে ৬৬টি সংস্থাকে নিবন্ধন দেয় ইসি। সেখানেও বেশ কিছু নামসর্বস্ব সংস্থা ছিল। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা আছে, এমন ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানও ছিল।

গতকাল সোমবার ইসি সচিবালয় থেকে সাংবাদিকদের জানানো হয়, পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে প্রাথমিকভাবে নিবন্ধনযোগ্য ২৯টি বেসরকারি সংস্থার তালিকা আজ মঙ্গলবার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করা হবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে কারও কোনো দাবি, আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে তা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে ইসি সচিবের কাছে লিখিতভাবে জানানো যাবে। এরপর শুনানি শেষে তালিকা চূড়ান্ত হবে।

‘সোসাইটি ফর রুরাল নিড’ (স্রাবন) নামের যে সংস্থাকে তালিকায় রাখা হয়েছে, তার ঠিকানা দেওয়া হয়েছে বরিশালে। গতকাল ওই ঠিকানায় গিয়ে সংস্থাটির কোনো কার্যালয় খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ইসির দেওয়া সর্বশেষ তালিকায় দেখা যায়, যে ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে ইসি নিবন্ধন দিতে যাচ্ছে, তাতে ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম, সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এর আগে আবেদন করলেও নিবন্ধন পায়নি। গত জাতীয় নির্বাচনে অনভিজ্ঞ কয়েকজন বিদেশি নাগরিককে পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়ে এসে সমালোচিত হয়েছিল সার্ক মানবাধিকার ফোরাম। আর এবার নির্বাচনের আগে সম্প্রতি কয়েকজন বিদেশি নাগরিককে দেশে এনে ‘বিদেশি পর্যবেক্ষক’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম।

আরও পড়ুন

ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের চেয়ারম্যান আবেদ আলী। তিনি সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনেরও মহাসচিব। অবশ্য ইসিতে সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিঞা। আর বেশ কয়েকটি সংস্থার জোট ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছেন আবেদ আলী।

প্রথম দফায় বাদ পড়ার পর আবার কীভাবে কয়েকটি সংস্থা নিবন্ধনযোগ্য হলো, এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পূরণ করে যারা নতুন করে আবেদন করেছে, তাদের নিবন্ধনযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

এই সংস্থাগুলোকে নির্বাচন কমিশন পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে নিবন্ধন দিচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থাহীনতা যে যৌক্তিক, তা তাদের এই কাজের মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হচ্ছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার

তালিকায় নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান

ইসি এবার যে ২৯টি সংস্থাকে নিবন্ধন দিতে যাচ্ছে তার একটি ‘উদ্ভাবনী মহিলা সংস্থা’। খুলনার ফুলতলার দামোদরপুর এলাকার এই বেসরকারি সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মারিয়া ভূঁইয়া মহিলা আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় কর্মী। এই সংস্থার নিজস্ব কর্মী আছেন পাঁচজন।

২০১৮ সালের নির্বাচনে অন্য একটি পর্যবেক্ষক সংস্থার কাজে সহযোগিতা করেছিলেন উল্লেখ করে মারিয়া ভূঁইয়া গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ভাইয়েরা যুবলীগ নেতা ছিল। আমিও রাজনীতি করি; যেহেতু আমার একটা সংগঠন আছে, এ জন্য রাজনীতির পদে থাকতে পারি না। যেমন খুলনায় আওয়ামী লীগের জনসভায় আমার কর্মী দেওয়ার কথা ছিল। আমি নিজেও গেছি, লোকও দিয়েছি।’

‘সোসাইটি ফর রুরাল নিড’ (স্রাবন) নামের যে সংস্থাকে তালিকায় রাখা হয়েছে, তার ঠিকানা দেওয়া হয়েছে বরিশালে। গতকাল ওই ঠিকানায় গিয়ে সংস্থাটির কোনো কার্যালয় খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওই ঠিকানায় উত্থান নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নামফলক আছে। নামফলকে উল্লেখ করা ফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে আশরাফ হোসেন নামের একজন ফোন ধরেন। তিনি বলেন, তিনিই স্রাবনের নির্বাহী পরিচালক। এটা মূলত তাদের উপকার্যালয়। তাদের প্রধান কার্যালয় পটুয়াখালীর বাউফলে। উত্থানের কার্যালয়ে তাঁরা স্রাবনের কার্যক্রম চালাচ্ছেন।

ইসি এবার যে ২৯টি সংস্থাকে নিবন্ধন দিতে যাচ্ছে তার একটি ‘উদ্ভাবনী মহিলা সংস্থা’। খুলনার ফুলতলার দামোদরপুর এলাকার এই বেসরকারি সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মারিয়া ভূঁইয়া মহিলা আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় কর্মী। এই সংস্থার নিজস্ব কর্মী আছেন পাঁচজন।

এই প্রতিষ্ঠানে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে আশরাফ হোসেন বলেন, ‘না আমাদের তা নেই। কারণ, আমরা ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম করি না। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ করি। বর্তমানে আমাদের কোনো প্রকল্প নেই।’

বাউফলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্রাবন নামের প্রতিষ্ঠানটি নামসর্বস্ব। তাদের তেমন কোনো কার্যক্রম নেই।

ইসির তালিকায় থাকা বেডো আর্থসামাজিক কেন্দ্রের কার্যালয় সিরাজগঞ্জের বেলকুচির একটি গ্রামে। এলাকায় এই সংস্থাটির তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। গতকাল বেলকুচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফিয়া সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, কিছুদিন আগে তিনি এই সংস্থার একটি প্রশিক্ষণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। তাদের তেমন জনবল নেই বলে তাঁর মনে হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি খোঁজ নেবেন।

সোশ্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিউনিটি অর্গানাইজেশন (সাকো) পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার ইউনিয়ন পর্যায়ের একটি সংস্থা। এটির সভানেত্রী মোসা. শাহনাজ খানম। তবে এটি মূলত পরিচালনা করেন তাঁর ছেলে মো. আদনান শাওন। তিনি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ও পটুয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি।

এবারের নির্বাচন সামনে রেখে দুই দফায় দেশি সংস্থাকে পর্যবেক্ষক হিসেবে নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে। গত সেপ্টেম্বরে ৬৬টি সংস্থাকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। তবে ইসি মনে করছে, আগের তুলনায় এবার দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার সংখ্যা অনেক কম। তাই এই সংখ্যা বাড়াতে আবারও গত ১৪ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফায় আবেদন আহ্বান করে ইসি। নির্ধারিত সময়ে ১৪৯টি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে। যাচাই-বাছাই শেষে ইসি গতকাল ২৯টি সংস্থাকে নিবন্ধন দেওয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, আবেদ আলীর সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন নামের প্রতিষ্ঠানটি গত নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষক আনার নামে একধরনের জালিয়াতি করেছিল। এবারও কিছুদিন আগে ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম কয়েকজন বিদেশি নাগরিককে এনে বিদেশি পর্যবেক্ষক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। এই সংস্থাগুলোকে নির্বাচন কমিশন পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে নিবন্ধন দিচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থাহীনতা যে যৌক্তিক, তা তাদের এই কাজের মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হচ্ছে।

 (প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা)