শেখ হাসিনার মুখে ঘটনার বর্ণনা

২০০৪ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো গ্রেনেড হামলা ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কজনক অধ্যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই হত্যাচেষ্টার মামলা নিয়ে গড়িমসি চলে। তৎকালীন সরকার নানা উপায়ে তদন্তও বিপথে নেয়। প্রতিষ্ঠার পর ২৫ বছর ধরে প্রথম আলো অনবরত অনুসন্ধান করে চলেছে সমসাময়িক ইতিহাসের চাপা দেওয়া ঘটনার পেছনের সত্য। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা তার অন্যতম। প্রথম আলোর মহাফেজখানা থেকে সে অনুসন্ধানের কিছু নির্বাচিত অংশ পাঠকদের জন্য পেশ করা হলো।

সুধা সদনে কথা বলার সময় বিমর্ষ শেখ হাসিনা। ২২ আগস্ট ২০০৪
ছবি: শামসুল হক

বিভীষিকাময় সেই ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও সে সময়ের বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। সেদিন মুহুর্মুহু গ্রেনেড হামলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল অনেক মানুষের দেহ। কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেই হামলা থেকে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। নেতা-কর্মীরা নিজেদের জীবন দিয়ে রক্ষা করেন শেখ হাসিনাকে। বর্তমানে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ২০০৮ সালের ১১ জুন ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেয়। এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার ফজলুল কবীর উপকারাগারে সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে জানতে শেখ হাসিনার সাক্ষ্য নেন। ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬১ ধারা অনুযায়ী শেখ হাসিনার বক্তব্য লিপিবদ্ধ করা হয়, যা আদালতে দেওয়া নথিতেও সংযুক্ত এবং অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

শেখ হাসিনা তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন, ২০০৪ সালে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর গ্রেনেড হামলা এবং গোপালগঞ্জে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার মুক্তাঙ্গনে একটি প্রতিবাদ শোভাযাত্রা করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আগেই অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়। কিন্তু ২০ আগস্ট সকাল পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ মুক্তাঙ্গনে শোভাযাত্রা করার অনুমতি না দেওয়ায় আওয়ামী লীগ ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের সামনে শোভাযাত্রা করার প্রস্তুতি নেয়।

জবানবন্দিতে শেখ হাসিনা জানান, ২১ আগস্ট বিকেল সাড়ে চারটায় তিনি ধানমন্ডির সুধা সদন থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের উদ্দেশে রওনা হন। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে পৌঁছার পর মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত ট্রাকে ওঠেন। ট্রাকের অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে আনুমানিক ১৫-২০ গজ পূর্ব দিকে। তিনি ওই ট্রাকে দাঁড়িয়ে কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন।

শেখ হাসিনার বক্তব্য অনুযায়ী, আনুমানিক পাঁচটা ২০ থেকে ২২ মিনিটের দিকে তাঁর বক্তব্য শেষ হয়। এরপর তিনি ট্রাক থেকে নিচে নামার জন্য অগ্রসর হচ্ছিলেন; এমন সময় ফটোসাংবাদিক এস এম গোর্কি ছবি তোলার সুযোগ চাইলে শেখ হাসিনা একটু থামেন। ঠিক তখনই, সম্ভবত দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ হয়। বিপদ বুঝতে পেরে তিনি এবং ট্রাকের ওপরে থাকা অন্যরা মাথা নিচু করে শুয়ে বা বসে পড়েন।

এরই মধ্যে পরপর কয়েকটি বিস্ফোরণ ঘটে। ট্রাকে অবস্থানরত নেতারা মানবঢাল তৈরি করে তাঁকে রক্ষার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন। কিছুক্ষণ পরে বিস্ফোরণ একটু থামলে তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মীরা তাঁকে ট্রাক থেকে নামিয়ে বুলেটপ্রুফ জিপে তোলার চেষ্টা করেন। তিনি জিপের দিকে অগ্রসর হলে আবারও বিস্ফোরণ শুরু হয়।

এরপর তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মীরা তাঁকে পুনরায় টেনে ট্রাকে থাকা টেবিলের নিচে নিয়ে যান এবং মানবঢাল তৈরি করে তাঁর প্রাণ রক্ষায় তৎপর হন। একপর্যায়ে তাঁকে বুলেটপ্রুফ জিপে তোলা হয়। এর মধ্যে আবারও বিস্ফোরণ ঘটে। সন্ধ্যা অনুমান ছয়টার সময় তিনি সুধা সদনে পৌঁছান।

শেখ হাসিনা তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, সভামঞ্চের ট্রাকে তিনি ছাড়াও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল, মহীউদ্দীন খান আলমগীর, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবদুর রাজ্জাক, প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, কাজী জাফর উল্লাহ, জিল্লুর রহমান, আমির হোসেন আমু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। পরে জানতে পারেন যে বিস্ফোরণ ছিল গ্রেনেডের।

শেখ হাসিনা আরও বলেন, ঘটনার সময় পুলিশের বিশেষ শাখা—এসবির প্রোটেকশন দলের সদস্যরা তাদের অস্ত্র থেকে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেও ডিএমপির প্রোটেকশন দল কোনো ভূমিকাই রাখেনি।

বরং তিনি ঘটনাস্থল থেকে ফেরার পর আউটার স্টেডিয়ামের পশ্চিম দিকের রাস্তা দিয়ে যখন জিরো পয়েন্টের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখন পুলিশ টিয়ার শেল ও শটগান থেকে গুলি করে তাঁদের যাত্রাকে ব্যাহত করে।

তিনি আরো বলেন, গ্রেনেড হামলার ঘটনায় আইভি রহমানসহ তাঁদের ২২ নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন এবং শত শত নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। তাঁর নিজেরও শ্রবণশক্তি লোপ পেয়েছে। দেশে-বিদেশে চিকিৎসা করেও ডান কানের শ্রবণশক্তি স্বাভাবিক হয়নি বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।

প্রথম আলো, ২১ আগস্ট ২০১০