রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা সুপ্রিম কোর্টের কাছে ন্যস্ত হবে। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করে এ রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় তিন মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে বিচারপতি আহমেদ সোহেল ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল মঙ্গলবার এ রায় দেন। আশবাদ ব্যক্ত করে রায়ে আদালত বলেছেন, বিচার বিভাগ শুধু কাগুজে স্বাধীন হবে না। সত্যিকার স্বাধীনতা এর কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রত্যেক নাগরিকের কাছে উপস্থিত হবে।
বর্তমান সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিষয়ে বলা আছে। এতে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরিসহ শৃঙ্খলা বিধানের বিষয়টি রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি তা প্রয়োগ করবেন বলে উল্লেখ রয়েছে।
রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে বিদ্যমান ১১৬ অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জন্য সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষের প্রস্তাব অনুসারে রায়ের অনুলিপি গ্রহণের পর বিশেষত তিন মাসের মধ্যে সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে বিবাদীদের নির্দেশ দেওয়া হলো।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন হাইকোর্টের রায়ের বিষয়ে গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারতসহ প্রায় সব দেশেই অধস্তন আদালতের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ সেসব দেশের উচ্চতর আদালতের অধীনে রয়েছে। আমাদেরও ছিল। এই নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির কাছে ন্যস্ত করাটা ছিল অনেক সমস্যার কারণ। আদি সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল হওয়া খুবই ইতিবাচক। হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগে বহাল থাকলে অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, রায়ের আলোকে বাহাত্তরে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বহাল হওয়া প্রয়োজন।’
বর্তমানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সাংঘর্ষিক
১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে, বিচারকর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগে দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান, ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকবে। আর ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এই দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে তা প্রয়োগ করবেন।
রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ৩৯ ধারা অনুসারে ১১৬ অনুচ্ছেদের সংশোধন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল করা হলো। একইভাবে ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনী আইনের ১৯ ধারার মাধ্যমে ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনও সাংঘর্ষিক বলে বাতিল করা হলো।
সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী ও ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ের সিদ্ধান্ত অনুসারে, ১৯৭২ সালের সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদ যেভাবে ছিল, সেভাবে সংবিধানে পুনর্বহাল হবে।
পৃথক বিচার বিভাগ সাংবিধানিক অধিকার
রায়ে বলা হয়, জাতীয় সংসদ সচিবালয় এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আছে, যাদের স্বাধীন পরিচয় রয়েছে। অথচ বিচার বিভাগের জন্য কোনো সচিবালয় গঠিত হয়নি।
সংবিধানের ২২, ১০৭ ও ১০৯ অনুচ্ছেদ এবং মাসদার হোসেন মামলার রায়ের নির্দেশনা উল্লেখ করে আদালত বলেন, বিচার বিভাগ অবশ্যই নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হবে। অধস্তন আদালতের তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত হবে। কার্যক্রম ও কাঠামোগতভাবে বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের স্বাধীন অঙ্গ। স্বাধীনভাবে কাজ করতে এবং সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্রের অন্য দুটি অঙ্গ (আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগ) থেকে বিচার বিভাগ পৃথক; নির্বাহীর ছাতার নিচে কিংবা মিশে কাজ করতে পারে না। পৃথক বিচার বিভাগ সাংবিধানিক অধিকার।
১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ মাসদার হোসেন মামলায় ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দিয়েছিলেন। এটি নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকসংক্রান্ত মামলা হিসেবে পরিচিত। ১৯৯৫ সালে হাইকোর্টে যখন মামলাটি করা হয়, তখন বিচার অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ছিলেন মাসদার হোসেন।
বর্তমান অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মাসদার হোসেন গতকাল রায়ের পর প্রথম আলোকে বলেন, আপিল বিভাগের রায়ের (১২ দফার ৮ নম্বর নির্দেশনা) নির্দেশনা অনুসারে নির্বাহী এবং আইনসভা থেকে বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ মুক্ত রাখতে হবে। সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে অধস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর হাইকোর্ট বিভাগের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের ক্ষমতা থাকবে। হাইকোর্টের রায়ে সাংবিধানিক এই বাধ্যবাধকতা এবং আট নম্বর নির্দেশনার পূর্ণ প্রতিফলন হয়েছে।
মাসদার হোসেন আরও বলেন, হাইকোর্টের রায়ের ফলে অধস্তন আদালত আইন মন্ত্রণালয় তথা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হবে। একই সঙ্গে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর হলেও সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গগুলো হতে বিচার বিভাগের পৃথক্করণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে’—এই প্রতিশ্রুতি কার্যকর হতে যাচ্ছে।
‘রায় ঐতিহাসিক’
সুপ্রিম কোর্টের সাত আইনজীবীর গত বছরের ২৫ আগস্ট করা এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে গতকাল রায় দেন হাইকোর্ট। রিটে বর্তমান সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ, ২০১৭ সালের জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালার বৈধতা চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি বিচার বিভাগীয় পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছিল।
প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট গত বছরের ২৭ অক্টোবর রুল দেন। গত ২৩ এপ্রিল রুলের ওপর শুনানি শুরু হয়, যা ১৩ আগস্ট শেষ হয়। সেদিন আদালত রায়ের জন্য গতকাল তারিখ রাখেন।
রুলে সারবত্তা আছে উল্লেখ করে তা যথাযথ (অ্যাবসলিউট) ঘোষণা করে রায় দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করে রায়ে আদালত বলেছেন, বিধিমালা মূল সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মাসদার হোসেন মামলার রায়ে উল্লেখিত নির্দেশনার সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ নয়।
একই সঙ্গে সংবিধান ও আইনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা জড়িত থাকায় আপিলের জন্য সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে সার্টিফিকেট ইস্যু করেছেন আদালত।
আদালতে রিট আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির শুনানি করেন। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক এবং ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদি হাসান শুনানিতে অংশ নেন। অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূইয়া এবং ইন্টারভেনর (পক্ষ) হয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম শুনানিতে অংশ নেন।
সংবিধান সংস্কার কমিশন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব উল্লেখ করে রায় বলা হয়, এতে দেখা যায়, বিদ্যমান ১১৬ অনুচ্ছেদ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে না। এটি সর্বোত্তম ধরন নয়, যদি না সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত করা হয়।
হাইকোর্টের রায় ঐতিহাসিক বলে অভিহিত করেছেন রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রায়ের পর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ রায়ের ফলে অধস্তন বিচার বিভাগ শাসন বিভাগের কর্তৃত্ব থেকে মুক্তি পাবে। বিচারকেরা তাঁদের আত্মমর্যাদা ফিরে পাবেন। তাঁদের বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা বিধান পুরোপুরি সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত হবে। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নামে আইন মন্ত্রণালয়ের খবরদারি থেকে স্বাধীনতা লাভ করবে।