ভোরের আলোয় আলোর পথযাত্রার আহ্বানে ছায়ানটের বর্ষবরণ

রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন। এবারের আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ছবি: জাহিদুল করিম

ভোরের আলো সবে এসে স্পর্শ বুলিয়ে দিয়েছে রমনার নিবিড় সবুজ পাতায় পাতায়। তারও আগে ঘুমের জড়তা কাটিয়ে উৎসবের সাজে সেজে দলে দলে নারী-পুরুষ এসে সমবেত হয়েছেন বটমূল চত্বরে। বটমূলের মঞ্চে সারি দিয়ে বসেছেন ছায়ানটের সংগীত ও যন্ত্রশিল্পীরা। উষার আলো ফুটতেই সুপ্রিয়া দাস ছড়িয়ে দিলেন প্রভাতের ভৈরবী রাগালাপ। তাঁর কণ্ঠের সুরে সুরে আজ সোমবার সূচনা হলো বাংলা ১৪৩২ সনকে স্বাগত জানিয়ে ছায়ানটের বাণী ও সুরের প্রভাতি আয়োজন।

ছায়ানটের এবারের আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। দেশ, মানুষ, প্রকৃতিকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে আঁধার পেরিয়ে আলোর পানে যাত্রার আহ্বান ছিল আজকের আয়োজনে। এবার ৫৮ তম বারের মতো রমনার বটমূলে অনুষ্ঠিত হলো ছায়ানটের এই আয়োজন। তারা শুরু করেছিল ১৯৬৭ সালে। তখন চলছিল আইয়ুব খানের কঠিন সামরিক শাসন। পূর্ব পাকিস্তানে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জারি করা হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা। ছায়ানট সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বাঙালি সংস্কৃতির জাগরণে বিপুল উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আয়োজন করেছিল পয়লা বৈশাখে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। তার পর থেকে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে দেশের এই ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। রমনার বটমূলে ২০০১ সালে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ঘটে ভয়ংকর বোমা হামলা। কিন্তু তাতে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে ছায়ানটের অগ্রযাত্রা থেমে যায়নি। বরং আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে নতুন উদ্যমে তাদের সাংস্কৃতিক জাগরণের অভিযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। তাদের এই নববর্ষের অনুষ্ঠান কালক্রমে বহু সাংস্কৃতিক সংগঠনকে অনুপ্রাণিত করেছে। বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান দেশের ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষের সবচেয়ে বড় প্রাণের উৎসবে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে ছায়ানটের এই প্রভাতি আয়োজনের রয়েছে বিপুল অবদান।

এবার ৫৮তম বারের মতো রমনার বটমূলে অনুষ্ঠিত হলো ছায়ানটের এই আয়োজন
ছবি: জাহিদুল করিম

আজ সোমবার বরাবরের মতোই ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছিল সম্মেলক ও একক কণ্ঠের গান এবং আবৃত্তি দিয়ে। এতে ছিল ৯টি সম্মেলক, ১২টি একক কণ্ঠের গান ও ৩টি আবৃত্তি। অংশ নিয়েছিলেন প্রায় দেড় শ শিল্পী।

সূচনার রাগালাপের পরে গানের পালা শুরু হয়েছিল সম্মেলক কণ্ঠের ‘নতুন প্রাণ দাও, প্রাণসখা’ গানটি দিয়ে। এরপর দীপ্র নিশান্ত পরিবেশন করেন ‘তিমির দুয়ার খোলো,’ সেঁজুতি বড়ুয়ার কণ্ঠে ছিল ‘আপনারে দিয়ে’। এরপর আবার সম্মেলক কণ্ঠের গান ‘তুমি প্রভাতের সকরুণ ভৈরবী’। তারপর মোস্তাফিজুর রহমান গেয়েছেন ‘ভেঙেছে দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়’। গানের শেষে ‘ঝড়ের খেয়া’র নির্বাচিত অংশ আবৃত্তি করেন জহিরুল হক খান। এভাবেই গানে–আবৃত্তিতে এগিয়ে যায় অনুষ্ঠান।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। ক্রমেই ভরে ওঠে বটতলার সবুজ চত্বর। পুরান ঢাকার আজিমপুর সেকশন থেকে পাঁচ বছরের মেয়ে সাফিরা আয়রাকে নিয়ে এসেছিলেন ব্যবসায়ী শাহ হোসেন। মেয়ের পরনে লাল রঙের জমিনে সাদা ব্লক প্রিন্টের শাড়ি। তার হাতে একটি একতারাও আছে। সে বলল, ‘আসার সময় বাবা কিনে দিয়েছে।’ শাহ হোসেন সংগীতানুরাগী। ছায়ানটের এই প্রভাতি বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে নিয়মিত আসেন। ২০০১ সালে বোমা হামলা বছরেও এসেছিলেন। বললেন, মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে অনুষ্ঠানে এসেছেন শৈশব থেকেই বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। এমন অনেকেই সপরিবার এসেছিলেন ছায়ানটের গানে গানে বর্ষবরণের এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠতে।

গতকালের অনুষ্ঠানে একক কণ্ঠের গানের মধ্যে খায়রুল আনাম শাকিল গেয়েছেন ‘গগনে প্রলয় মেঘের খেলা’,‘ লাইসা আহমদ লিসা গেয়েছেন ‘আকাশে দুই হাতে প্রেম বিলায়’, চন্দনা মজুমদার গেয়েছেন,‘মন সহজে কি সই হবা’। একক কণ্ঠের শিল্পীদের মধ্যে আরও ছিলেন—ফারহানা আক্তার, সুমন মজুমদার, সৈয়দা সনজিদা জোহরা, আবুল কালাম আজাদ, ফারজানা আক্তার ও সুস্মিতা দেবনাথ। আবৃত্তিতে ছিলেন, সুমনা বিশ্বাস ও জয়ন্ত রায়। সম্মেলক গানগুলো মধ্যে কয়েকটি ছিল ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’, ‘মোরা সত্যের পরে মন’, ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম’, ‘ও আলোর পথ যাত্রী’, ‘আইজ আইলো রে বছর ঘুরি’।

ছায়ানটের অনুষ্ঠানে গান-আবৃত্তির শেষে থাকে নববর্ষের কথন। সাধারণত ছায়ানটের সভাপতি সংগীতজ্ঞ সন্‌জীদা খাতুন এই কথন পাঠ করতেন। তাঁর ইন্তেকালের পর এবার সেই দায়িত্ব পালন করেছেন নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী। কথন শেষে তিনি ফিলিস্তিনের জনগণের মুক্তির সংগ্রামের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ ও ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর ইসরায়েলের হামলার তীব্র নিন্দা প্রকাশ করেন। ফিলিস্তিনে নিহতদের প্রতি শোক প্রকাশ করে সবাই মিলে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। পরে জাতীয় সংগীত পরিবেশনা দিয়ে শেষ হয় ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।

ছায়ানটের অনুষ্ঠানে গান-আবৃত্তির শেষে নববর্ষের কথন পাঠ করেন নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী
ছবি: জাহিদুল করিম

নববর্ষের কথন:

‘মুক্তির অন্বেষায়, দীর্ঘ বন্ধুর পথপরিক্রমায় অর্ধশতক বর্ষ পূর্বে, বিপুল আত্মদানের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ওই যাত্রাপথের নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে, ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে বাঙালির শিল্প, সাহিত্য, সংগীতসহ সকল মাধ্যম এবং বিভিন্ন স্থাপনায়। বাঙালির স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামে অনন্য মাত্রা যুক্ত করেছে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে এই অসাম্প্রদায়িক উৎসব, নতুন বাংলা বছরকে বরণ করার আয়োজন। আমরা এক আলোকিত দেশ ও সমাজের স্বপ্ন দেখি, যে দেশের মানুষ সর্বজনের শান্তি-স্বস্তি-নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ধর্ম-জাতি-বিত্তের বিভাজন ভাঙবে, গড়বে উদার সম্প্রীতির সহিষ্ণু সমাজ।

‘বাঙালির মানবতার মুক্তিসাধনা স্বাধীন আপন দেশেও প্রত্যাশা এবং আশাভঙ্গের নানান চড়াই-উতরাইয়ের দোলাচল প্রত্যক্ষ করেছে। নববর্ষের উষালগ্নে, আজ চোখ ফেলি হিসাব-নিকাশের হালখাতায়। একদিকে মুক্তির জন-আকাঙ্ক্ষা অর্জনের প্রত্যাশা, অন্যদিকে পীড়াদায়ক বিদ্বেষ-বিভক্তি, নারী-শিশুর অমানবিক মর্যাদাহানি ও অপরিণামদর্শী অসহিষ্ণুতা। সব অতৃপ্তি প্রতিবিধানের দায় রাষ্ট্রের, তবে সমাজকেও সে দায় নিতে হয় বৈকি। সবাই ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ, মুক্তচিন্তার নির্ভয় প্রকাশ, আবহমান সংস্কৃতির নির্বিঘ্ন যাত্রা হৃদয়ে ধারণ করলে, মুক্তির আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সুগম হবেই।’