নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কায়েতপাড়ার বাসিন্দা সাইদুর রহমান অনলাইনে জমির নামজারির (খারিজ) আবেদন করেছিলেন তিন মাস আগে। কিন্তু উপজেলা ভূমি সহকারী কর্মকর্তার কার্যালয়ে ওই আবেদনের নথিপত্র (হার্ড কপি) জমা না দেওয়ায় তা পড়ে ছিল। পরে আবার অনলাইনে আবেদনের পর কার্যালয়ে গিয়ে নথিপত্র জমা দেন তিনি।

এর দিন দশেক পর গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ওই আবেদনের অগ্রগতি জানতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলা ভূমি সহকারী কর্মকর্তার কার্যালয়ে এসেছিলেন সাইদুর রহমান। এ সময় প্রথম আলোর কাছে তিনি অভিযোগ করেন, নথি জমা দেওয়ার সময় কর্মচারীদের ঘুষ দিতে হয়েছে।

ওই দিন রূপগঞ্জ উপজেলা ভূমি সহকারী কর্মকর্তার কার্যালয়ে সেবা নিতে আসা আরও পাঁচজনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাঁদের মধ্যে তিনজন বলেন, ই-নামজারির বিষয়ে তাঁদের ধারণা নেই। তাঁরা কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে দালালের মাধ্যমে আবেদন করেছেন।

যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তবে এর মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। ভুক্তভোগীদের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো উচিত।
আলী ইমাম মজুমদার, সাবেক মন্ত্রিপরিষদের সচিব

এ জন্য তাঁদের দিতে হয়েছে পাঁচ শ থেকে দেড় হাজার টাকা। বাকি দুজন ই-নামজারি সম্পর্কে জানেন। তবে এরপরও কম্পিউটারের দোকান থেকে আবেদন করতে তাঁদের খরচ হয়েছে আড়াই শ থেকে তিন শ টাকা।

অনলাইনে আবেদন করার পরও সশরীর কার্যালয়ে কেন এসেছেন, এমন প্রশ্নে তাঁরা জানান, অনলাইনে করা আবেদনের নথি ভূমি সহকারী কর্মকর্তার কার্যালয়ে জমা দেওয়া ‘বাধ্যতামূলক’। ঘুষ ছাড়াও কোনো কাজ হয় না।

ওই সেবাগ্রহীতাদের করা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেল পাশেই এক টেবিলে। সেখানে অফিস সহকারী শহীদুল আবেদনের নথিপত্র জমা নিচ্ছিলেন। এ সময় ‘চা-পানির খরচ’-এর কথা বলে তিনি একেকজনের কাছ থেকে ২০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছিলেন। যদিও পরে তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এমন তো হওয়ার কথা নয়, এমনটা হয়নি।

ভূমি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সেবা সহজ করার লক্ষ্যে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ই-নামজারি বাধ্যতামূলক করা হয়। চালু করা হয় ঘরে বসে অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের সেবাও। এ উদ্যোগের প্রধান উদ্দেশ্য, সাধারণ মানুষের হয়রানি কমানো এবং ঘরে বসে সেবা নেওয়া নিশ্চিত করা।

জানতে চাইলে রূপগঞ্জের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা কামরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ই-নামজারির আবেদনের পর নথিগুলো ভূমি কার্যালয় থেকেই ডাউনলোড করে নেওয়া হয়। তবে কেউ হার্ড কপি দিতে চাইলে সেটি কাজের সুবিধার্থে নেওয়া হয়। তবে হার্ড কপি না দিলেও সমস্যা নেই। তবে টাকা নেওয়ার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন। টাকা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই, এমন দাবি করে কামরুল হাসান বলেন, এরপরও বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।

ভূমি সংস্কার বোর্ড সূত্র জানায়, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ই-নামজারির সিস্টেমে ৭১ লাখ ৩২ হাজার আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৬০ লাখ ২৯ হাজারটি আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে। নিষ্পত্তির হার ৮৫ শতাংশ।

ই-নামজারি বাধ্যতামূলক করার পর এর সুফল কতটা মানুষ পাচ্ছেন, এ বিষয়ে একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে জানতে চাওয়া হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ মানুষ এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে অভ্যস্ত না হওয়ায় দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ছেন। যে লক্ষ্যে ই-নামজারির পদ্ধতি চালু করা হয়েছে, সেটি আর বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, ই-নামজারির আবেদনের পর হার্ড কপি নেওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ভূমি কার্যালয়ের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী এখনো প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন করতে পারেননি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেটের গতি খুবই কম।

আবেদন করার ২৮ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করা হয় উল্লেখ করে ভূমি সংস্কার বোর্ডের সদস্য (প্রশাসন, অতিরিক্ত সচিব) জয়নাল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, ই-নামজারি শতভাগ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় পুরোপুরি সুফল পেতে একটু সময় লাগবে। কারণ, এটা সম্পর্কে এখনো সাধারণ মানুষ পুরোপুরি জানেন না।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদের সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তবে এর মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। ভুক্তভোগীদের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো উচিত।