‘পরিচিত হাত’ দেখলেই কাছে আসে গাপ্পি

সাড়ে চার বছর আগে শখের বশে অ্যাকুয়ারিয়ামে মাছ চাষ শুরু করেছিলেন অ্যাঞ্জেলা দম্পতি। সেটাই এখন তাঁদের আয়ের উৎস

বাসার একটি কক্ষে কাচঘেরা বাক্সে অ্যাকুয়ারিয়ামে রাখার মাছ গাপ্পি চাষ করেন অ্যাঞ্জেলা সজ্জন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরের আকবরশাহ হাউজিং সোসাইটির বাসায়ছবি: সৌরভ দাশ

স্বচ্ছ কাচের ভেতর পানিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা রঙের মাছ। হাত দিয়ে ছুঁতে চাইলেই দূরে সরে যাচ্ছে। তবে একটি ‘পরিচিত হাত’ দেখলেই ছুটে কাছে আসছে মাছেরা। ঝাঁক বেঁধে খেয়ে নিচ্ছে পানির ওপর ছড়িয়ে দেওয়া খাবার। কোনো মাছের রং হলুদ, কোনোটি লাল, আবার কোনোটিতে রংধনুর মতো হরেক রঙের মিশ্রণ।

অ্যাকুয়ারিয়ামে থাকা এসব মাছের নাম গাপ্পি। লাতিন আমেরিকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এই শৌখিন মাছগুলো রংধনু নামেও পরিচিত। বাড়িতে এই মাছগুলো চাষ করেন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া অ্যাঞ্জেলা সজ্জন (২৩)। কাচের ওপর অ্যাঞ্জেলা হাত রাখলেই যেন মাছগুলো বুঝতে পারে, এটি তাদের বন্ধুর হাত।

চলতি বছর চট্টগ্রাম নগরের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন অ্যাঞ্জেলা। ২০১৮ সালে অনেকটা শখের বসেই নিজের বাসায় গাপ্পি চাষ শুরু করেন। একসময় দেখেন, অ্যাকুয়ারিয়ামে মাছের বংশবিস্তার হচ্ছে। এরপর স্বামী মিল্টন আলফ্রেড গোমেজকে সঙ্গে নিয়ে নিজের শখকে রূপ দিয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়। এখন গাপ্পি ও মলির ১৫টি জাতের মাছ আছে তাঁদের সংগ্রহে। শৌখিন সংগ্রাহকরা এসব মাছ কিনছেন। মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বাড়তি আয়ও হচ্ছে এ থেকে।

নগরের আকবর শাহ হাউজিং সোসাইটি এলাকায় অ্যাঞ্জেলা দম্পতির বাস। তাঁদের ঘরে বসার কক্ষে দেখা গেল ১৭টি অ্যাকুয়ারিয়াম-ট্যাংক। এগুলো ব্যবহার করা হয় মাছের প্রজননের জন্য। এ ছাড়া পাশে দুটি চৌবাচ্চায় আছে আরও মাছ। অ্যাঞ্জেলাদের বাসার বারান্দা ও অন্যান্য ঘর মিলিয়ে আছে আরও ৭ থেকে ৮টি ট্যাংক ও চৌবাচ্চা। এগুলোতে গাপ্পি চাষ করা হয়। প্রায় ১৫ প্রজাতির কয়েক শ গাপ্পি মাছ ভেসে বেড়ায় অ্যাকুয়ারিয়ামগুলোতে। গাপ্পির পাশাপাশি কিছু মলি প্রজাতির মাছও আছে।

শুরু যেভাবে

প্রথম দিকে ছোট একটি ট্যাংকে গাপ্পির প্রজননের জন্য আবাসস্থল তৈরি করেন অ্যাঞ্জেলা দম্পতি। রেডটেইল প্লাটিনাম ও ডাম্বো মোজাইক প্রজাতির গাপ্পি প্রজনন করেন। পরে সেখান থেকে পোনা তৈরি হয়। এই সাফল্য দেখে তাঁরা আমদানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিয়ে আসেন প্রায় ১০ হাজার টাকার কয়েক প্রজাতির গাপ্পি মাছ ও সরঞ্জাম।

ক্রেতার ওপর নির্ভর করেই আরও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আনার ইচ্ছা আছে। দেশের বাইরে হোম ব্রিড অ্যাকুয়ারিয়াম মাছের চাহিদা আছে। তাই সুযোগ হলে দেশের বাইরেও মাছ রপ্তানি করতে চাই
অ্যাঞ্জেলা সজ্জন, উদ্যোক্তা

২০২০ সালে সংকর করে বেশ কিছু নতুন রঙের গাপ্পি পান তাঁরা। সেগুলোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে পোস্ট করা শুরু করেন। ‘চিটাগাং গাপ্পি অ্যাডমায়ারার্স’ নামে তাঁদের ফেসবুক পেজে মাছ কিনতে চেয়ে বেশ কিছু খুদেবার্তা পেতে শুরু করেন। এরপরই ক্রেতাদের আগ্রহেই শুরু করেন শৌখিন মাছ বিক্রি।

এরপর একে একে বাড়তে থাকে অ্যাকুয়ারিয়াম ও মাছের সংখ্যা। ঘরের ভেতরে খুব সহজে ব্রিড (বংশবৃদ্ধি) করানো যায় গাপ্পি। গাপ্পি নিজেরাই ব্রিড করতে সক্ষম। চাষেও পরিশ্রম কম। এখন প্রায় প্রায় এক লাখ টাকার মাছ ও সরঞ্জাম আছে অ্যাঞ্জেলা দম্পতির মাছ চাষ প্রকল্পে। প্রতি মাসে আয় হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা।

কাচের বাক্সে বড় হয়ে উঠছে রঙিন মাছ
ছবি: প্রথম আলো

বর্তমানে অ্যাঞ্জেলা দম্পতির বাসায় ২৫টির বেশি অ্যাকুয়ারিয়াম ও ১৫ প্রজাতির বেশি গাপ্পি মাছ রয়েছে। প্রকারভেদে একেকটা মাছ ৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। এক জোড়া প্রাপ্তবয়স্ক গাপ্পি থেকে ৫০টির মতো পোনা পাওয়া যায়। এর মধ্যে অন্তত ২০টি পোনাকে বাঁচানো সম্ভব হয়।

অ্যাঞ্জেলার এ শৌখিন মাছ চাষে সহযোগিতা করেন তাঁর স্বামী মিল্টন আলফ্রেড গোমেজ। স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি মাছগুলো দেখাশোনা করেন। মিল্টন আলফ্রেড গোমেজ চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা। তিনি নিজেও একজন মৎস্যপ্রেমী। তাই স্ত্রীর সঙ্গে শৌখিন মাছ চাষের দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছেন তিনি। শৈবাল ও শামুক দিয়ে ‘সেলফ সাসটেইনিং’ অ্যাকুয়ারিয়াম তৈরি করা, মাছের বিভিন্ন জাত নিয়ে গবেষণার দায়িত্ব গোমেজের ওপর।

স্ত্রীর শৌখিন মাছ চাষ বিষয়ে জানতে চাইলে মিল্টন আলফ্রেড গোমেজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম দিকে পরিবারের অন্য সদস্যরা একটু চিন্তিত ছিলেন। কারণ, পানি কিংবা তাপমাত্রার তারতম্য হলেই মাছ মারা যায়। তবে তাঁরা সব সময় আমাদের পাশে ছিলেন। এখন অনেক খুশি। মানসিক প্রশান্তির জন্য হলেও মাছের কক্ষটি একবার ঘুরে যান তাঁরা।’

ভবিষ্যৎ ভাবনা

সাড়ে চার বছর আগে শখের বশে শুরু করা উদ্যোগ নিয়ে অনেকটা এগিয়েছেন অ্যাঞ্জেলা-আলফ্রেড দম্পতি। ইতিমধ্যে প্রতিবেশী দেশ ভারতে গিয়ে তাঁরা অংশ নিয়েছেন শৌখিন মৎস্য প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতায়। ভবিষ্যতে এ উদ্যোগ নিয়ে আরও বড় পরিসরে পরিকল্পনার কথা জানালেন তাঁরা।

অ্যাঞ্জেলা দম্পতির বাসায় ২৫টির বেশি অ্যাকুয়ারিয়াম ও ১৫ প্রজাতির বেশি গাপ্পি মাছ রয়েছে। প্রকারভেদে একেকটা মাছ ৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়।

বর্তমানে তাঁদের অ্যাকুয়ারিয়ামে গাপ্পি ও মলি মাছের নানা প্রজাতি। এর মধ্যে ব্লু অ্যান্ড রেড টোপাজ, ব্লু অ্যান্ড রেড গ্রাস, ব্লু অ্যান্ড রেড ড্রাগন, এইচবি ব্লু মস্কো, আলবিনো মস্কো, ইয়েলো টাক্সিডো, ভায়োলেট টাক্সিডো, ব্লু অ্যান্ড ব্ল্যাক মিক্সড লেইস, ইয়েলো ল্যাপার্ড, ওয়াইট প্লাটিনাম, মিক্সড ব্রিড গাপ্পি, বাম্বল বি প্ল্যাটি, আলবিনো কই, হোয়াইট মলি, গ্লো টেট্রা, মিকি মাউস প্ল্যাটি ও হোয়াইট অ্যান্ড ব্ল্যাক বেলুন মলিসহ বেশ কিছু প্রজাতির মাছের কথা জানা গেল।

মাছ চাষ নিয়ে নিজেদের স্বপ্নের কথা জানিয়ে অ্যাঞ্জেলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখন অ্যাকুয়ারিয়ামে মাছ পালন–সম্পর্কিত বিভিন্ন ভিডিও ফেসবুকে এবং ইউটিউবে দিচ্ছি, যাতে অন্যরাও এতে উদ্বুদ্ধ হন। ক্রেতার ওপর নির্ভর করেই আরও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আনার ইচ্ছা আছে। দেশের বাইরে হোম ব্রিড অ্যাকুয়ারিয়াম মাছের চাহিদা আছে। তাই সুযোগ হলে দেশের বাইরেও মাছ রপ্তানি করতে চাই।’