এমএ পাস রুবেল ভিক্ষা করারও পরামর্শ পেয়েছেন

আরটিভি ‘অদম্য সম্মাননা’ প্রদান অনুষ্ঠানে রুবেল আলী। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান
ছবি: সংগৃহীত

‘গর্তের মধ্যে বুক পর্যন্ত মাটিচাপা দিয়ে রেখেছে সারা দিন। সাপের বিষ বলে কোনো কিছু দিয়ে দুই পা ডলতে বলছে। আমার পা ভালো করার জন্য কবিরাজ যা বলছে, সেটাই করেছেন আমার মা–বাবা। বড় হওয়ার পরও এমন অনেক অত্যাচার সহ্য করেছি। কিন্তু আমার পা ঠিক হয়নি। আমার দুই পায়েই কোনো শক্তি নেই।’

কথাগুলো পাবনার ঈশ্বরদীর মো. রুবেল আলীর। জানালেন, যখন হাঁটা শিখবেন, সেই বয়সেই পোলিও হয় তাঁর। এরপর শুরু হয় কবিরাজের অপচিকিৎসা। অভাব ও অজ্ঞতার কারণে তাঁর মা–বাবা তাঁকে কোনো চিকিৎসকের কাছে নিতে পারেননি। অপচিকিৎসায় দুটি পা পুরোপুরি অকেজো হয়ে যায়। এখন বসার সময় তিনি তাঁর ছোট ছোট দুই পা বুকের কাছে ভাঁজ করে রাখেন।

রুবেল এসব অপচিকিৎসার কিছু কথা মা–বাবার মুখে শুনেছেন। আর বড় হয়ে চিকিৎসার নামে তাঁর ওপর ‘অনেক অত্যাচার’ হয়েছে বলেই তিনি মনে করেন।

শিক্ষক ও বিভিন্ন ব্যক্তির সহায়তায় রুবেল স্নাতকোত্তর (এমএ) পাস করেছেন। বর্তমানে তিনি ঈশ্বরদীতে দাশুড়িয়া এমএম উচ্চবিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক।

রুবেল দুটি কাঠের টুকরার ওপর দুই হাতে ভর দিয়ে বেশির ভাগ সময় চলাফেরা করেন। হাতে ভর দিয়েই লাফিয়ে চেয়ারে বসা বা চেয়ার থেকে নামার মতো কাজগুলোতে কারও সহায়তা লাগে না তাঁর। চেয়ারে বসেই তিনি ব্ল্যাকবোর্ডে লিখতে পারেন। এ ছাড়া ইঞ্জিনের একটি তিন চাকার সাইকেল আছে তাঁর। সেটি  চালিয়েই স্কুলে যাতায়াত করেন। দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্যদের সহায়তার প্রয়োজন হয়। তবে বেশির ভাগ কাজ তিনি নিজেই করেন।

কাঠের টুকরার ওপর হাতের ভর দিয়ে চলাফেরা করেন রুবেল আলী
ছবি: মানসুরা হোসাইন

গত শনিবার বিকেলে রুবেলের সঙ্গে দেখা হয় এই প্রতিবেদকের। রুবেল বেসরকারি টেলিভিশন আরটিভির ‘অদম্য সম্মাননা’ প্রদান অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। সব প্রতিবন্ধকতা পেছনে ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি আরটিভির অদম্য সম্মাননা পেয়েছেন। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বেঙ্গল মাল্টিমিডিয়া স্টুডিওতে সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে সঞ্চালক রুবেলের নাম ঘোষণার পর তিনি চেয়ার থেকে নেমে কাঠের দুই টুকরাতে ভর করে নিজেই মঞ্চে ওঠেন। এ সময় আরটিভির স্বেচ্ছাসেবকেরা তাঁকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু রুবেল দৃঢ় গলায় তাঁদের জানিয়ে দেন, তিনি একাই মঞ্চে উঠতে পারবেন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর রুবেল জানালেন, তিনি যে স্কুলে শিক্ষকতা করেন, সেখানে সবাই তাঁকে সম্মান করেন। শিক্ষার্থীরাও তাঁকে পছন্দ করে। তবে ‘ল্যাংড়া’ ও ‘খোঁড়া’ বলে অনেকে ডেকেছেন অনেক সময়। রুবেল বললেন, ‘মানুষের এসব আচরণে মন খারাপ হয়। তবে তা মনে রাখলে তো আর চলে না। তাই ভুলে যাই। আমি ইতিবাচক চিন্তা করতেই বেশি পছন্দ করি।’

২০১২ সালে রুবেলের মা-বাবা যান। বাবা ছিলেন কৃষক। মায়ের মৃত্যু হয়েছে ২০১৮ সালে। রুবেলের এক ভাই ও এক বোন আছে। বললেন, ‘আমাদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। কাদা মাড়িয়ে স্কুলে যেতাম। স্যাররা সবার কাছ থেকে পাঁচ টাকা করে চাঁদা তুলে আমি চালাতে পারব এমন একটা সাইকেল বানিয়ে আমাকে দেন। পরে অন্যদের সহায়তায় আরেকটা সাইকেল কেনা হয়। স্কুল–কলেজে স্যাররা সাহায্য করেছেন সব সময়। তাই এমএ পাস করতে পেরেছি।’

শ্রেণিকক্ষে বসে বেসরকারি টেলিভিশন আরটিভিকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন রুবেল আলী
ছবি: সংগৃহীত

রুবেলের বয়স ৩৩ বছর। সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য আবেদন করেছেন। কোথাও চাকরি হয়নি। ‘প্রতিবন্ধী’ হওয়ার কথা বলে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়। তাঁর এ অবস্থা দেখে গ্রামবাসীর সহায়তায় স্কুল কর্তৃপক্ষ খণ্ডকালীন শিক্ষকের চাকরি দেন। বেতন পান সাত হাজার টাকা। রুবেল বললেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে সরকারের ভাতা পান তিনি। তবে সেটা তিন মাসে মাত্র ২ হাজার ৪০০ টাকা। সামান্য এই আয় দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

রুবেল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এমএ পাস করার পর অনেক জায়গায় চাকরির জন্য গিয়েছি। সেখানেও শুনতে হয়েছে, মানুষের কাছে হাত পাতলেই আমি নাকি বেশি টাকা আয় করতে পারব। তবে আমি ভিক্ষা করতে চাই না। যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি একটা চাকরি চাই, যাতে একটু ভালোভাবে বাঁচতে পারি।’  

রুবেলের কথায়, তাঁর জীবনের কষ্ট সিনেমায় দেখানো কষ্টের মতো। সবাইকে দেখানো গেলে কেউ চোখের পানি আটকাতে পারবে না। জানালেন, এ জীবনে প্রতি পদে অবহেলা ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। স্কুলে ভর্তি হতেও সংগ্রাম করতে হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের একটি স্কুলে অডিটের জন্য কর্মকর্তারা আসবেন। কিন্তু স্কুলে একজন শিক্ষার্থী কম হচ্ছিল। তাই রুবেলকে নিয়ে স্কুলে বসানো হয়েছিল। এটা না হলে এ জীবনে স্কুলে যাওয়াই হতো না। অডিটের কর্মকর্তারা চলে যাওয়ার পর এলাকার কয়েকজন ওই স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেন। পড়াশোনায় ভালো বলে পরে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পড়ার সুযোগ পান।

স্ত্রী আঁখি খাতুন ও দুই সন্তানের সঙ্গে রুবেল আলী
ছবি: সংগৃহীত

উপজেলা শিক্ষা অফিসের একাডেমিক সুপারভাইজার আরিফ হোসেনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রুবেল জানালেন, একবার আরিফ হোসেন বর্তমানে তিনি যে স্কুলে শিক্ষকতা করছেন, সেখানে অডিটে আসেন। সেখানেই আরিফ হোসেনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। এরপর আরিফ হোসেন রুবেলের ছবি দিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। সেই পোস্ট দেখে একটি বেসরকারি টেলিভিশন রুবেলকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আর সেই সূত্রেই আরটিভির বিশেষ প্রতিনিধি সৈয়দা মুনিরা ইসলাম রুবেলের বাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যান। তাঁর জীবনের গল্প নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেন। এরপরই তিনি আরটিভির অদম্য সম্মাননা পেলেন।  

স্ত্রী আঁখি খাতুন এবং ছোট ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে রুবেলের সংসার। তিনি বললেন,‘একটি কলমের জন্যও দুই দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে আমাকে। তাহলেই বোঝেন আমাদের অবস্থা কতটা খারাপ ছিল। এখনো অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।’