ক্যাম্পিং: প্রকৃতির কোলে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা

একটা সময় অবকাশযাপন মানেই ছিল কক্সবাজারের সমুদ্র কিংবা বান্দরবানের পাহাড়। কিন্তু এখন অনেকেই খুঁজছেন ভ্রমণের নতুন অভিজ্ঞতা। শহরের কোলাহল থেকে দূরে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে দু-একটা দিন কাটানোর জন্য তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ‘ক্যাম্পিং’ বা তাঁবুবাস। এটি কেবল ভ্রমণ নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব করার এক অসাধারণ সুযোগ।

বাংলাদেশের মতো নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর দেশে ক্যাম্পিংয়ের সম্ভাবনা অসীম। দেশের এমন অনেক জায়গা রয়েছে, যেগুলো অনেক ভ্রমণপিপাসুই ক্যাম্পিংয়ের জন্য আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করেন।

দেশের ১০টি দর্শনীয় ক্যাম্পিংয়ের স্থান

চর কুকরি-মুকরি, ভোলা

নামের সঙ্গে চর থাকলেও এটা আসলে দ্বীপ। ভোলার চরফ্যাশনে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মোহনায় জেগে আছে। জঙ্গল আর জলরাশি সহজেই ভুলিয়ে দেয় শহুরে জীবনের জটিলতা। আর রাতের নিস্তব্ধতায় তারাভরা আকাশপানে চেয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

মারায়ন তং, বান্দরবান

মিরিঞ্জা রেঞ্জের পাহাড়টির নাম মারায়ন তং। প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে তাঁবুবাসের জন্য বান্দরবানের আলীকদমের এই পাহাড়চূড়া দারুণ জনপ্রিয়। এখান থেকে সূর্যোদয় দেখার অভিজ্ঞতা অনন্য। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষণে ক্ষণে বদলায় পাহাড়ি প্রকৃতির রূপ।

সোনাদিয়া দ্বীপ, কক্সবাজার

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত পর্যটকদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে। তবে যাঁরা জনারণ্য পছন্দ করেন না, তাঁদের জন্য আছে মহেশখালীর সোনাদিয়া সমুদ্রসৈকত। এখানকার সৈকতে তাঁবুতে থাকা রাতটি হতে পারে জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের একটি। আর ঝাউবনে হ্যামক টানিয়ে দোল খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারেন অখণ্ড অবসর।

সাজেক ভ্যালি, রাঙামাটি

পাহাড়ি সৌন্দর্যের এক অপরূপ নিদর্শন সাজেক। টেন্ট বা তাঁবুতে রাত কাটানোর সময় যখন মেঘ এসে আপনার চারপাশে ভিড় করবে, তখন বাস্তব আর স্বপ্নের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

রেমা-কালেঙ্গা, হবিগঞ্জ

কথায় আছে, বন দেখতে হয় রাতে। তেমনই একটি রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য। রাতে এখানে নিবিড় নৈঃশব্দ্য এসে ভর করে। জঙ্গলের ঝিঁঝিপোকার দল মহোৎসাহে ক্লান্তিহীন ডাকতে থাকে। তবে সেই শব্দ বনের পরিবেশের সঙ্গে অবলীলায় মিশে যায়।

নীলগিরি ও নীলাচল, বান্দরবান

পাহাড়ি পথে ঘেরা এই জায়গাগুলো ক্যাম্পিংয়ের জন্য চমৎকার। তারাভরা আকাশের নিচে ঘুমানোর সঙ্গে ভোরের প্রথম সূর্যের আলোয় পাহাড়ি প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন।

মনপুরা, ভোলা

সাইক্লিং ও ক্যাম্পিংয়ের আদর্শ জায়গা মনপুরা। এই দ্বীপের অন্যতম আকর্ষণীয় দিক মাইলের পর মাইল সবুজ ম্যানগ্রোভ বন। বনের চারপাশ ঘিরে আছে নদী। নদীপারে তাঁবু ফেলে কাটিয়ে দেওয়া যায় একটি আনন্দময় রাত।

তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড়

কনকনে শীত উপভোগ করতে মহানন্দার পাড়ে তাঁবুবাস করেন অনেকই। কেউ কেউ চা-বাগানেও তাঁবু ফেলেন। কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ দর্শনের সুযোগ মেলে বলে ক্যাম্পারদের কাছে এটি খুবই জনপ্রিয়।

নিঝুম দ্বীপ, নোয়াখালী

বঙ্গোপসাগরের বুকে মেঘনা নদীর মোহনায় জেগে আছে নিঝুম দ্বীপ। এই দ্বীপ সরকারঘোষিত জাতীয় উদ্যান। এখানকার সৈকত বা জঙ্গলের কাছে তাঁবু ফেলতে পারেন। তাঁবুর ব্যবস্থা বন বিভাগও করে। দরকার আগে থেকে যোগাযোগের।

কাপ্তাই, রাঙামাটি

কর্ণফুলী নদীর তীর, লেকের পাড়, সুউচ্চ পাহাড়ের পাদদেশ—কাপ্তাইয়ের যেখানেই তাঁবু ফেলা হয়, সেটাই যেন হয়ে ওঠে মনের মতো ক্যাম্পিং সাইট। অরণ্যের নির্জনতা এখানে নেই, নেই শব্দের অযাচিত বৈরিতা।

ক্যাম্পিংয়ের জন্য যা প্রয়োজন

ক্যাম্পিং করার আগে এর প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কী কী সরঞ্জাম, সেগুলো প্রাপ্তির স্থান এবং সামগ্রিক বিষয় নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ট্রাভেল এজেন্সি ‘চলঘুরি লিমিটেড’–এর পরিচালক এবং চিফ বিজনেস অফিসার শোয়েব বিন নুর। তিনি এমন কিছু প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের কথা বলেছেন, যেগুলো ক্যাম্পিংয়ের জন্য দরকার। সেগুলো হলো টেন্ট, স্লিপিং ব্যাগ, টর্চ, পাওয়ার ব্যাংক, খাবার ও রান্নার সরঞ্জাম, প্রাথমিক চিকিৎসার সামগ্রী, আবহাওয়ার উপযোগী পোশাক ও অনুষঙ্গ, মশা ও প্রকৃতিতে থাকা উপদ্রবকারী কীটপতঙ্গ থেকে বাঁচতে ক্রিম বা কয়েল, তাঁবু আলোকিত করার জন্য ল্যাম্প, দিনের বেলা তাঁবুর বাইরে থাকতে ছাতা, চা বা কফি খাওয়ার ফ্লাক্স ইত্যাদি। ঢাকার কাঁটাবন, বায়তুল মোকাররম স্টেডিয়াম মার্কেট, নিউমার্কেট, বনানী বা অনলাইনে বিভিন্ন ই-কমার্স সাইটে ভালো মানের ক্যাম্পিং সরঞ্জাম পাওয়া যায়, সুলভ মূল্যেই।

কিছু প্রয়োজনীয় টিপস

ক্যাম্পিংয়ের জন্য দরকার সঠিক ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা। যে জায়গায় ক্যাম্প করতে অনুমতির প্রয়োজন হয়, সেখানকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। কোনোভাবেই পরিবেশদূষণ করবেন না। প্লাস্টিক বা বর্জ্য যেখানে-সেখানে ফেলা যাবে না। আর নিরাপত্তার কারণে দলবদ্ধভাবে ক্যাম্পিংই ভালো। প্রয়োজন হলে একজন গাইড রাখা যেতে পারে। এ ছাড়া তাঁবুবাসের পরিকল্পনার সময়ই আবহাওয়া বিবেচনা করতে হবে। খুব দরকার না হলে ভারী, অতিরিক্ত ও মূল্যবান জিনিস না নিয়ে যাওয়াই ভালো। এতে বাড়তি ঝামেলা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

ক্যাম্পিং শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যের উপভোগ নয়, বরং জীবনের এক অন্য রকম রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাও বটে। তাই প্রস্তুতি নিন বেরিয়ে পড়ুন প্রকৃতির কোলে কিছুটা সময় নিজেকে সঁপে দেওয়ার মানসিকতায়।