নারীর রাজনৈতিক হিস্যা বুঝিয়ে দিতে হবে

‘গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে নারীর হিস্যা’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে জাতীয় নাগরিক কমিটিছবি: প্রথম আলো

সমাজে এমনভাবে নারীকে উপস্থাপন করা হয়, যেন নারী রাজনীতি কম বোঝেন। সচেতনভাবে নারীর রাজনৈতিক সত্তাকে বিকশিত হতে দেওয়া হয়নি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরও আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকা নারীদের এক পাশে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। নারীকে তাঁর রাজনৈতিক হিস্যা সমানভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। নারী নেতৃত্বকে হারাম বলা ব্যক্তিদের রাজনীতিতে প্রত্যাখ্যান করবেন জনগণ।

আজ শনিবার বিকেলে রাজধানীর বাংলামোটরে জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ‘গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে নারীর হিস্যা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এ কথা বলেন বক্তারা। সংগঠনের নারীবিষয়ক সেল এ সভার আয়োজন করে। সভায় জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল খেলা বন্ধ করে দিতে মাঠে হামলার ঘটনার প্রতিবাদ জানানো হয়।

জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, নারীর হিস্যা বুঝিয়ে দিতে না পারলে দেশ সামনে এগোবে না। নারী নেতৃত্বকে যাঁরা হারাম বলছেন, জনগণ গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁদের প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ ধরনের কথা যাঁরা বলবেন, ভবিষ্যতে তাঁদের রাজনীতিও প্রত্যাখ্যান করবেন জনগণ।

সংগঠনের সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ভাইয়ের মরদেহ কাঁধে নিয়ে দুই বোন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছেন। সেই ভিডিও আন্দোলনে আরও জীবন দিতে আন্দোলনকারীদের উদ্বুদ্ধ করেছে। নারীর নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।

সংগঠনের মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, ফ্যাসিবাদী সরকার ১৫ বছরে নারী নেতৃত্ব তৈরির পুরো প্রক্রিয়াকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। নারীকে নিয়ে রাজনীতির প্রচলিত সংস্কৃতির পরিবর্তন করা হবে।

নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে সম্পত্তির অধিকার জড়িত উল্লেখ করে সামান্তা শারমিন বলেন, দেশে এই মুহূর্তে নারীর সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করার জন্য যে আইন ব্যবহার করা হয়, সেটি পাকিস্তান আমলের আইন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের আইন দিয়ে শ্রম আইন, পেনাল কোড (দণ্ডবিধি) ও পুলিশ আইন ইত্যাদি করা হচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়ন ও সম্পত্তির অধিকার নিয়ে ভবিষ্যতে আলাপ তোলা জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া নারীদের পরবর্তী সময়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। তিনি বলেন, আন্দোলনে অংশ নেওয়া নারীদের মধ্যে ৫ আগস্টের পর কানাঘুষা চলছিল যে নারীদের একপাশে সরিয়ে (সাইডলাইন) দেওয়া হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে, আগস্ট-সেপ্টেম্বরেই নারীদের সোচ্চার হওয়া উচিত ছিল। অভ্যুত্থানের কিছু পরে নারীদের হেনস্তা করা শুরু হয়। সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে লক্ষ্য করে হেনস্তা করা হয়। এর বিরুদ্ধে তখনই নারীরা সরকারের কাছে বিবৃতি চেয়েছিলেন, কিন্তু সাড়া পাওয়া যায়নি। নারীর জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বড় আকারে কর্মসূচি নেবে বলে তিনি জানান।

জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম সদস্যসচিব আবদুল্লাহ আল আমিন বলেন, আন্দোলনের সময় নারী-পুরুষ ভেদাভেদ করে গুলি আসেনি। রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হলে নারী-পুরুষ সহযোদ্ধা। আর যখন পাওয়ার হিসাব হয়, তখন নারী-পুরুষের আলাদা হিসাব চলে আসছে।

যুগ্ম আহ্বায়ক তাসনিম জারা বলেন, যেকোনো অভ্যুত্থানে নারীদের বিষয়গুলো পরে দেখার জন্য অপেক্ষা করতে বলা হয়। সেই সময় আর আসে না। পরিবর্তনের জন্য বর্তমানই সবচেয়ে ভালো সময়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাফিয়া রেহনুমা বলেন, নারী ও পুরুষের ভোটের মূল্য সমান। অথচ সচেতনভাবে নারীর রাজনৈতিক সত্তাকে বিকশিত হতে দেওয়া হয়নি। শুধু রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে নারীকে ব্যবহার করা হয়েছে।

জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য রুমানা জান্নাত বলেন, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে নারীর হিস্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হচ্ছে, এটা দুঃখজনক। আন্দোলনের সময় নারী যখন রাস্তায় নেমেছিলেন, তখন তিনি নারী পরিচয়ে নন, নাগরিক পরিচয়ে নেমেছিলেন। এই সমাজ বিশ্বাস করে না, নারীরা রাজনীতিতে নেতৃত্বে আসতে পারেন।

কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তাসনুভা জাবিন বলেন, ‘এই অভ্যুত্থানের পর এক ঝাঁক নারী নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে। সামনে যেসব নতুন রাজনৈতিক দল আসবে, তাতে নারীর বড় অংশীদারত্ব দেখতে চাই।’

জাতীয় নাগরিক কমিটির নারী বিষয়ক সেলের সম্পাদক সাদিয়া ফারজানা দিনা বলেন, ‘জাতীয় নাগরিক কমিটির নারী বিষয়ক সেলের সম্পাদক হিসেবে আমি এই সেলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি এই উদ্দেশে যেন বাংলাদেশে নারীদের জন্য আর কোনো বিশেষ নারী সেলের প্রয়োজন থাকবে না; নারীরা যেন শুধু নারীদের নেত্রী না, জনমানুষের নেত্রী হয়ে উঠতে পারে।’

আলোচনায় আরও অংশ নেন জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য দ্যুতি অরণ্য চৌধুরী, অর্পিতা শ্যামা দেব, হুমায়রা নূর, সাঈদা আক্তার, শিক্ষার্থী আশরেফা খাতুনসহ অনেকে। সভা সঞ্চালনা করেন সংগঠনের নারীবিষয়ক সেলের সম্পাদক সাদিয়া ফারজানা।

সংশোধনী: এই প্রতিবেদনে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিনের বক্তব্যে সম্পত্তিতে নারীর অধিকারবিষয়ক অংশে ভুলবশত সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছিল। তিনি প্রকৃতপক্ষে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলেছিলেন। অনাকাঙ্ক্ষিত এই ভুলের জন্য আমরা দুঃখপ্রকাশ করছি।