মৌসুম শেষ না হতেই আম রপ্তানিতে রেকর্ড

গত বছর বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ৭৫৭ মেট্রিক টন আম রপ্তানি হয়েছিল। এ বছর ২০ জুলাই পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ১২৩ মেট্রিক টন।

বিদেশে পাঠানোর জন্য চলছে আম প্রক্রিয়াজাতের কাজ। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার কলিগ্রামে
ফাইল ছবি

দেশে আমের মৌসুম শেষ হতে এখনো মাসখানেক বাকি। এর মধ্যেই আম রপ্তানিতে অতীতের রেকর্ড ভেঙে গেছে। একই সঙ্গে বেড়েছে আম রপ্তানিকারকও। শুধু তা-ই নয়, এবার বাংলাদেশের আম গেছে নতুন নতুন দেশে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ বছর রপ্তানি গত বছরের দ্বিগুণ হতে পারে।

দেশে আমের উৎপাদন প্রতিবছর বাড়ছে। নতুন নতুন এলাকা আম উৎপাদনের আওতায় আসছে। উৎপাদনের সঙ্গে বেড়েছে আম রপ্তানির পরিমাণও। কৃষি অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে, অর্থাৎ গত বছর বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ৭৫৭ মেট্রিক টন আম রপ্তানি হয়েছিল, যা এর আগের বছরে ছিল ৭৯১ মেট্রিক টন। এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ উইং সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ২০ জুলাই পর্যন্ত সময়ে ২ হাজার ১২৩ টন আম রপ্তানি হয়েছে।

আরও পড়ুন

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চলতি বছর আম রপ্তানি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। রপ্তানি প্রবণতা অনুযায়ী, গত বছরের চেয়ে এ বছর দ্বিগুণ বা এর বেশি আম রপ্তানি হতে পারে।

আমের পরিকল্পিত উৎপাদন হলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে আরও বেশি পরিমাণ আম রপ্তানি সম্ভব
অধ্যাপক মোহা. কামরুল হাছান

এ বছর ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, পর্তুগাল ও সুইজারল্যান্ডে ৪০ টন আম পাঠিয়েছে গ্লোবাল ট্রেড লিংক নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী রাজিয়া সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, চলতি বছর তাঁরা আরও আম পাঠাবেন। এ বছর রপ্তানিকারকও অনেক বেড়েছে বলে জানান তিনি।

স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিগুণে বাংলাদেশের আমের মান ভালো বলে মনে করেন কৃষিবিদ ও পুষ্টিবিদেরা। তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশের আমের চাহিদা রয়েছে বিভিন্ন দেশে।

আরও পড়ুন

নতুন গন্তব্য ও রপ্তানিকারক বাড়ছে

বাংলাদেশের আমের বাজার বাড়ছে। রপ্তানি হওয়া দেশের তালিকায় প্রতিবছর নতুন নতুন দেশ যুক্ত হচ্ছে। গত বছর আম রপ্তানি হয়েছিল ২৮টি দেশে। এ বছর ইতিমধ্যে ৩১ দেশে আম রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাজ্যে—৯৬৮ টনের বেশি। এরপরই ইতালি।

নতুন দেশের পাশাপাশি আম রপ্তানিকারকও বেড়েছে। নতুন নতুন রপ্তানিকারকও আম রপ্তানিতে যুক্ত হচ্ছেন। গত বছর ৬৬ রপ্তানিকারক কাগজে-কলমে থাকলেও এর মধ্যে ছয় থেকে সাতজন আম রপ্তানি করেননি। তবে এ বছর ৭০-এর বেশি রপ্তানিকারক আম রপ্তানি করেছেন।

গ্লোবাল ট্রেড লিংকের রাজিয়া সুলতানা
ছবি: সংগৃহীত

দেশে আম রপ্তানিতে যুক্ত বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্ট এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির উপদেষ্টা মো. মনজুরুল ইসলাম বলেন, আম রপ্তানিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অনেক কমেছে। তাই এখন নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান আম রপ্তানিতে যুক্ত হচ্ছে।

রপ্তানির ভবিষ্যৎ, কিছু বাধা

কৃষিবিদ ও রপ্তানিকারকেরা বলছেন, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের আমের বড় চাহিদা আছে। বাংলাদেশের আম সে জায়গা নিতে পারে। কিন্তু রপ্তানিতে পণ্যের গুণগত মান, মোড়কজাত খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে এ বছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) ‘রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের’ আওতায় ৯৩০ উদ্যোক্তার কাছ থেকে শুধু রপ্তানির জন্য আম সংগ্রহ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মোহা. কামরুল হাছান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আম রপ্তানির জন্য চুক্তিবদ্ধ খামারি তৈরি করার এ প্রচেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা মানসম্পন্ন পণ্য রপ্তানি করতে পারছেন। তবে খামার থেকে বন্দরে যাওয়ার জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন দরকার। আবার আমাদের দেশে প্যাকেজিংটাও খুব ভালো হয় না। সেটাও দরকার।’

আম প্যাকেটজাত করার ক্ষেত্রে সমস্যার কথা জানালেন গ্লোবাল ট্রেড লিংকের স্বত্বাধিকারী রাজিয়া সুলতানা। তিনি বলেন, ‘বিদেশিরা আমের প্যাকেটে কোনো ধাতব পদার্থের ব্যবহার পছন্দ করে না। কিন্তু আমাদের দেশে প্যাকেটগুলোতে পিনের ব্যবহার করা হয়। আবার প্যাকেট বানাতে যে বোর্ড ব্যবহার করা হয়, তা-ও খুব মানসম্পন্ন হয় না অনেক ক্ষেত্রে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টেক্স ফাউন্ডেশন আন্তর্জাতিক বাজারে কৃষিপণ্যের রপ্তানির উন্নয়নে কাজ করে। এর মধ্যে পণ্য প্যাকেটজাতে সহায়তার বিষয়টিও রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিটুল কুমার সাহা বলেন, ‘উন্নত মানের মোড়ক তৈরিতে আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। এ খাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো করেছে। তবে এবার আমরা ভার্জিন পাল্প থেকে উন্নত মানের মোড়ক তৈরি করেছি। সেগুলো রপ্তানিকারকেরা নিয়েছেনও।’

বৈশ্বিকভাবে এখনো পিছিয়ে

বাংলাদেশ আম রপ্তানিকারক দেশের শীর্ষ তালিকায় নেই। ফলবাজার নিয়ে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক পর্যালোচনা প্রতিবেদন বলছে, সবচেয়ে বেশি আম রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে রয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। ২০২২ সালে ভারত ১ লাখ ৭৩ হাজার টনের মতো আম রপ্তানি করেছে। এদিকে পাকিস্তানের রপ্তানি ছিল প্রায় ১ লাখ ৪১ হাজার টন। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে মেক্সিকো—৪ লাখ ৬৮ হাজার টন। থাইল্যান্ডও রপ্তানি করেছে প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার টন আম।

আম নিয়ে একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের আমের উৎপাদন ও বিপণনের মধ্যে অন্তত ২৫ শতাংশ আম নষ্ট হয়ে যায়। এর ৫০ শতাংশও যদি রক্ষা করা যায়, তবে আম রপ্তানিতে বাংলাদেশ অনেক ভালো করবে বলে মত দেন অধ্যাপক মোহা. কামরুল হাছান। তিনি বলেন, ‘আমের পরিকল্পিত উৎপাদন হলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে আরও বেশি পরিমাণ আম রপ্তানি সম্ভব।’