ওরা অধিবর্ষ শিশু, স্বজনদের উচ্ছ্বাস

নানি সালমা বেগমের কোলে অধিবর্ষে জন্ম নেওয়া শিশু। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার এবং ১০০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু হাসপাতালে
ছবি: প্রথম আলো

নাতিকে কাপড়ে মুড়িয়ে কোলে নিয়ে হাসছিলেন নানি সালমা বেগম। আজ সকাল সাড়ে ১০টায় শিশুটির জন্ম হয়েছে। অস্ত্রোপচারের জন্য তারিখ নির্ধারণ করাই ছিল। তাই তাঁরা জানতেন, আজ ২৯ ফেব্রুয়ারি পরিবারে নতুন সদস্য আসবে। হাসতে হাসতে সালমা বেগম বললেন, শিশুটির বড় ভাইকে তিনি কৌতুক করে বলেছেন, ‘তোমার মতো প্রতিবছর জন্মদিনের উপহার নিতে আমার কাছে বায়না ধরতে পারবে না তোমার ভাই।’ এই নানি–নাতির সঙ্গে আজ বেলা একটায় দেখা হয়েছিল রাজধানীর মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার এবং ১০০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু হাসপাতালে।

বর্ষপঞ্জি অনুসারে, ৪ দিয়ে বিভাজ্য বছরগুলোকে অধিবর্ষ (লিপ ইয়ার) বলা হয়। প্রতিবার অধিবর্ষ এলেই শৈশবে পত্রিকায় পড়া এক গল্পের কথা মনে পড়ে। গল্পের মূল কিশোরী চরিত্র বন্ধুর জন্মদিনে উপহার নিয়ে গিয়ে দেখে সবার হাতে চারটে করে উপহারের প্যাকেট। কিশোরী ধন্দে পড়ে যায়। ঘটনা কী? শেষে সে বুঝতে পারে, বন্ধুর জন্মতারিখ ২৯ ফেব্রুয়ারি বা অধিবর্ষ।

লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষ নিয়ে রঙ্গ–তামাশাও কম হয় না। যেমন বছরে এক দিন বাড়া মানে বাড়তি খরচ। এই দিনে জন্ম নিলে, বিয়ে করলে চার বছর পরপর উদ্‌যাপন করতে হবে। এতে প্রতিবছর উপহার কেনার খরচ কমতে পারে। উল্টোভাবে একসঙ্গে চার উপহার কেনার বাড়তি চাপও নিতে হতে পারে।

আজ প্রথম আলোর ‘কথা com’ পাতায় ‘অধিবর্ষে বিয়ে’ নামে ফয়েজ রেজা ছড়ায় ছন্দে বলেছেন, ‘লিপ ইয়ারে দীর্ঘ বছর দীর্ঘ ফেব্রুয়ারি/ ঊনত্রিশে যার জন্ম আমি তার সাথে কি পারি?/ চার বছরে একদিনই তার জন্মদিনের পার্টি/ চার বছরে তার একটি কেক আমার লাগে চারটি।’

হাসপাতালের অবজারভেশন (পর্যবেক্ষণ) ওয়ার্ডের পাশে অপেক্ষমাণ চেয়ারে বসে থাকা বসিলার বাসিন্দা সালমা বেগম বললেন, জন্মদিন নিয়ে মজা করার উত্তরে বড় নাতি আরাফ আহমেদ (৭) বলেছে, উপহার পাওয়ার জন্য সে ২৮ ফেব্রুয়ারি ভাইয়ের জন্মদিন পালন করবে। সালমা বেগম জানান, এটি তাঁর মেয়ে বিউটি আক্তার আর জামাতা সারওয়ার হোসেনের দ্বিতীয় সন্তান।

হাসপাতালের তথ্য অনুসারে, অধিবর্ষ শুরুর পর রাত ১২টা থেকে আজ বেলা একটা পর্যন্ত ১৩টি শিশু জন্ম নিয়েছে। এর মধ্যে ২টি শিশুর জন্ম হয়েছে স্বাভাবিক প্রসবে। বাকিগুলোর জন্ম হয়েছে অস্ত্রোপচারে বা সিজারিয়ান সেকশনের (সি–সেকশন) মাধ্যমে।

হাসপাতালের অবজারভেশন ওয়ার্ডে মোট ২৭টি শয্যা ও ২টি কেবিন রয়েছে। ওয়ার্ডের ভেতরে স্বাভাবিক প্রসবের জন্য কক্ষ, অস্ত্রোপচার কক্ষ, দুটি কেবিন, প্রসূতিদের শয্যা (১৬টি) ও প্রসব–পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পর্যবেক্ষণের শয্যা (১১টি) রয়েছে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক (কৈশোর ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা) মো. মনজুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অধিদপ্তরের আনুমানিক হিসাব অনুসারে দেশে বছরে ৩৭ লাখ গর্ভধারণের ঘটনা ঘটে। মৃত অবস্থায় জন্ম, মাসিক নিয়মিত করণ (এমআর), গর্ভে শিশুর মৃত্যু বাদে বছরে আনুমানিক ২৪ লাখ শিশু জন্ম নেয়।
সেই হিসাবে দেশে দিনে গড়ে ৬ হাজার ৫৭৫টি শিশুর জন্ম হয়।

প্রজনন অধিকার নিয়ে গবেষণা ও নীতিনির্ধারণীবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গাটমাকার ইনস্টিটিউটের বাংলাদেশ কান্ট্রি প্রোফাইলে বলা আছে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বছরে ৫৩ লাখ ৩০ হাজার গর্ভধারণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৬ লাখ ৩০ হাজার অর্থাৎ অর্ধেকসংখ্যকই অনিচ্ছাকৃত। অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণের মধ্যে এমআর হয় ১৫ লাখ ৮০ হাজার। অর্থাৎ বছরে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার গর্ভধারণ হয়।

‘বাংলা বা আরবি মাস ধরে জন্মদিন করব’

আজ দুপুর ১২টায় হাসপাতালের অবজারভেশন ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, একটি বিছানায় পাশাপাশি দুটি শিশু শোয়ানো। একটি শিশুকে দেখিয়ে নূর–ই–জান্নাত নামে এক নারী বললেন, শিশুটির মা পুতুল সরকার (৩২) তাঁর বাল্যবন্ধু। এটি তাঁর বন্ধুর দ্বিতীয় সন্তান। বড় মেয়ের বয়স পৌনে ৩ বছর। তিনি জানান, বন্ধুর সন্তান প্রসবের সময়ে সেবা করার জন্য এক সপ্তাহ আগে তিনি নবাবগঞ্জ থেকে বন্ধুর মোহাম্মদপুরের বাসায় এসেছেন। পরে ওয়ার্ডের বাইরে শিশুটির বাবা তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, চিকিৎসক আজ অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের তারিখ দেওয়ায় আজ সকাল ৯টায় তাঁরা হাসপাতালে চলে আসেন। অধিবর্ষে সন্তান জন্ম নেবে, এটা জেনে তাঁরা দুজন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, প্রতিবছর ১৬ ফাল্গুন বা ১৮ শাবান জন্মদিন পালন করবেন।

ওই শিশুটির পাশে শোয়া শিশুটি মোহাম্মদপুরের ফেন্সি আক্তার (২০) ও মিরাজ মৃধার (২৫)। এটি তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান। শিশুটির দাদি বিবি সফুরা বলেন, প্রসবের তারিখ ছিল ১০ মার্চের পর। গতকাল বুধবার সকালে ব্যথা ওঠায় ও পানি ভাঙতে থাকায় তাঁরা ফেন্সিকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। চিকিৎসক অবস্থা দেখে ভর্তি নিয়ে নেন। আলট্রাসনোগ্রামে গর্ভের শিশুর অবস্থান উল্টো (পা নিচে) থাকায় রাত সাড়ে ১২টায় অস্ত্রোপচার করা হয়।  

ফুপু সালমা বেগমের কোলে অধিবর্ষে জন্ম নেওয়া শিশু। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার এবং ১০০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু হাসপাতালে
ছবি: প্রথম আলো

অধিবর্ষে জন্ম নেওয়া শিশুকে কোলে নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন আরেক নানি ফাতেমা বেগম। তখন বেলা পৌনে একটা। অস্ত্রোপচারকক্ষ থেকে বের করে শিশুটিকে সবে তাঁর কোলে তুলে দিয়েছেন এক নার্স। অধিবর্ষে জন্ম নেওয়া প্রসঙ্গে ঝলমল হাসি নিয়ে ফাতেমা বেগম বললেন, ‘আমার খুব মজা লাগতেছে, খালি হাসি পাইতাছে।’ শিশুটির বাবার নাম আম্বর আলী। মায়ের নাম রুমা আক্তার। দম্পতির ৬ বছর বয়সী প্রথম সন্তানও ছেলে। তাঁরা ঢাকার অদূরে আমিনবাজারে থাকেন।

একই রকম উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন অধিবর্ষে রাত দেড়টায় জন্ম নেওয়া শিশুর ফুপু সালমা বেগম ও নানি সোগরা বেগম। তাঁরা জানান, গতকাল নিয়মিত পরীক্ষার জন্য শিশুর মা ইমরানা আক্তারকে (২০) নিয়ে আসেন। মায়ের শারীরিক অবস্থা দেখে ভর্তি করেন চিকিৎসক। পানি ভেঙে যাওয়ায় অস্ত্রোপচার করা হয়। মেয়েশিশুটি বিউটি ও মো. ইজাজ দম্পতির প্রথম সন্তান।

বেলা সাড়ে ১২টায় মাসুদ আহমেদ ও আশা ইসলামের জন্ম নেওয়া শিশুটিকে বারবার জড়িয়ে ধরে ভালোবাসা প্রকাশ করছিল বড় বোন আসিয়া (৪)।

রাত ১২টা ২ মিনিটে স্বাভাবিক প্রসবে জন্ম নেয় শিশুটি

দারুস সালাম এলাকার বাসিন্দা জ্যোৎস্না বেগমের (৩২) সঙ্গে কথা হয় হাসপাতালের স্পেশাল কেয়ার নিউবর্ন ইউনিটের (স্ক্যানু) বাইরের একটি কক্ষে। স্বামী মো. রিপন পিকআপ ভ্যানচালক। এবার নিয়ে চতুর্থবার গর্ভধারণ করেন জ্যোৎস্না। তিনটি সন্তান বেঁচে আছে। সন্তান স্ক্যানুতে ভর্তি থাকায় খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি বললেন, গতকাল বেলা ১১টায় ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে আসেন। রাত ১২টা ২ মিনিটে স্বাভাবিক প্রসবে তাঁর মেয়ের জন্ম হয়। তাঁর আগের সন্তানগুলোও স্বাভাবিক প্রসবে জন্ম নেয়। এই হাসপাতালে এবার অধিবর্ষে জন্ম নেওয়া প্রথম শিশু এটি।
রাতে স্বাভাবিক প্রসবে জন্ম নেওয়া অপর শিশুটিকে নিয়ে অভিভাবকেরা সকালেই বাড়ি চলে গেছেন।  

অধিবর্ষে জন্ম নেওয়া শিশুকে নিয়ে বোন আসিয়ার উচ্ছ্বাস। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার এবং ১০০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু হাসপাতালে
ছবি: প্রথম আলো

হাসপাতালের উপপরিচালক ও গাইনি চিকিৎসক হেলেনা জেবীন প্রথম আলোকে বলেন, যেগুলো স্বাভাবিক প্রসব হওয়ার মতো অবস্থায় থাকে, সেগুলো সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। স্বাভাবিক প্রসবের উপকারিতা থাকায় একজন মাকে শুরু থেকেই স্বাভাবিক প্রসবের জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে তৈরি করতে হয়। মাকে বোঝাতে হয়, ব্যথা তীব্র পর্যায়ে উঠবে, তিনি যেন ধৈর্য ধারণ করেন। গর্ভাবস্থায় তিনি যেন হালকা ব্যায়াম ও সুষম খাবার খাওয়ার বিষয়গুলো মেনে চলেন। স্বাভাবিক প্রসবে দেরি হয় বলে অনেক সময় পরিবারের সদস্যরা অস্থির হয়ে চিকিৎসককে চাপ দেন অস্ত্রোপচার করতে।

হেলেনা জেবীন আরও বলেন, প্রয়োজন ছাড়া সি সেকশন যেমন করা উচিত নয়, তেমনি জোর করে স্বাভাবিক প্রসবও করা ঠিক নয়। অনেক সময় মায়ের শারীরিক অবস্থা খারাপ থাকে। অনেক মায়ের আগের সন্তান অস্ত্রোপচারে জন্ম নেওয়া। অনেক সময় গর্ভের শিশু উল্টো থাকে, আড়াআড়ি থাকে, কখনো গর্ভফুল নিচে চলে আসে। সেসব ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারে শিশু জন্ম দিয়ে মা ও সন্তানকে বাঁচানো হয়। তিনি জানান, জানুয়ারি মাসে হাসপাতালে ৫৮৪টি শিশুর জন্ম হয়েছে। এর মধ্যে স্বাভাবিক প্রসব ২৮৪টি।