দিবস একটি আছে, আরেকটি আসছে

৩০ ডিসেম্বরকে প্রবাসী দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব আজ মন্ত্রিসভায় উঠছে। ১৮ ডিসেম্বর পালিত হয় আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস।

ফাইল ছবি

৩০ ডিসেম্বরকে ‘প্রবাসী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। এ–সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব আজ মঙ্গলবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে উঠবে। প্রস্তাবটি পাস হলে আগামী বছর থেকে প্রবাসী দিবস সরকারিভাবে পালিত হবে।

দিবসটি ঘোষণার প্রস্তাব দিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। তারা বলছে, বিদেশে থাকা এক কোটিরও বেশি প্রবাসীকে জাতীয় উন্নয়নে অংশীদার করতে এ উদ্যোগ।

তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রবাসীদের জন্য একটি দিবস রয়েছে। সেটি হলো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ গৃহীত আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস (১৮ ডিসেম্বর)। দিবসটি সরকারিভাবে পালন করা হয়। এটির ১২ দিন পর আরেকটি দিবস পালন ও তার পেছনে অর্থ ব্যয় অপ্রয়োজনীয়। কেউ কেউ বলছেন, এসব দিবস পালনের বদলে প্রবাসীদের সমস্যাগুলোর সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

এই সব দিবস পালনের কোনো মানে হয় না, যদি না প্রবাসীদের সমস্যাগুলোর সমাধান করা হয়।
দেলোয়ার হোসেন, প্রবাসী বাংলাদেশি

সূত্র জানিয়েছে, প্রবাসী দিবস পালনের আগ্রহের কথা প্রথম জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত অভিবাসী দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি ৩০ ডিসেম্বরকে প্রবাসী দিবস পালনের প্রস্তাব দেন। এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ–সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সেখান থেকে সবুজসংকেত পাওয়ার পর প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করে অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠায়।

৩০ ডিসেম্বর প্রবাসী দিবস পালনের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুক্তি হলো, ওই সময় খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শুভ বড়দিনের ছুটি পেয়ে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশে আসেন। সে জন্য বছরের শেষ সময়কে বেছে নেওয়া হয়েছে।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দিবস পালনে আলোচনা অনুষ্ঠানের হলো ভাড়া, খাবার, ব্যাগ দেওয়া, পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ, র‍্যালি, সাজসজ্জা ইত্যাদি কাজে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা ব্যয় হয়।

আরও পড়ুন

আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস থাকার পরও কেন আরেকটি দিবস পালনের উদ্যোগ, তা জানতে কথা হয় প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে। তাঁরা বলছেন, আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস মূলত অভিবাসীকেন্দ্রিক। শ্রম অভিবাসী, উদ্বাস্তু, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভিবাসী ও উন্নত জীবনের আশায় প্রবাসে থাকা ব্যক্তি—সবার জন্য দিবসটি পালিত হয়। প্রবাসী দিবস তাঁদের জন্য, যাঁরা বিদেশে কাজ করে অথবা ব্যবসা করে দেশে অর্থ পাঠান। এটি জাতীয়ভাবে পালিত হবে।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন প্রথম আলোকে বলেন, প্রবাসীরা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসে তাদের প্রতি পুরোপুরি সম্মান দেখানো যায় না। সে কারণে নতুন আরেকটি দিবস পালন করা হবে। প্রবাসীরা যাতে বাংলাদেশের উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারেন, সে জন্য এই উদ্যোগ।

প্রবাসী দিবস পালনের পেছনে আরও কিছু যুক্তি তুলে ধরেন আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন। তিনি বলেন, ভারতে প্রতিবছর প্রবাসী দিবস পালিত হচ্ছে। আয়ারল্যান্ডসহ বিশ্বের আরও কিছু দেশে এই দিবস পালিত হয়। দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হবে প্রবাসে থাকা বাংলাদেশি, যাঁরা বিভিন্ন খাতে বিশেষজ্ঞ, তাঁদের দেশে কাজে লাগানো। তাঁদের বিনিয়োগ কাজে লাগানো। দেশের উন্নয়নে প্রবাসীদের কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সে উপায় খোঁজা হবে।

আরও পড়ুন

অবশ্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রবাসীদের বিনিয়োগ আকর্ষণে ব্যবসা সহজ করা দরকার। বিনিয়োগ করতে যে ভোগান্তি, তা দূর করতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। একটি দিবস পালনের মাধ্যমে তার কিছুই হবে না। ২০১৯ সালে রাজধানীর একটি হোটেলে অনাবাসীদের (এনআরবি) ডেকে দেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছিল সরকার। যদিও তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স আয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৮ম। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈধ পথে ২ হাজার ১০৩ কোটি মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন।

প্রবাসী শ্রমিকদের সমস্যা কী কী, তা জানতে কয়েকজন শ্রমিক ও একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানান, মূল সমস্যা অভিবাসনের ব্যয়। সরকার যে টাকা নির্ধারণ করে দেয়, তার অন্তত আড়াই গুণ অর্থ ব্যয় করে একজন শ্রমিককে বিদেশে যেতে হয়। বছরের পর বছর ধরে এটা চলছে। সরকার তেমন কিছুই করতে পারেনি।

অভিযোগ আছে, শ্রমিকেরা বিমানবন্দরে হয়রানির শিকার হন। দূতাবাসগুলোও প্রবাসীদের সঙ্গে ভালো আচরণ ও সহযোগিতা করে না। এক যুগেরও বেশি সময় সৌদি আরবে বসবাসরত বাংলাদেশি দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাসপোর্ট নবায়ন করতে অন্য দেশের প্রবাসীদের সময় লাগে ১০ দিন। আমাদের দুই মাসেও হয় না। প্রবাসীরা সমস্যায় পড়লে সহযোগিতা পাওয়া যায় না।’ তিনি বলেন, এই সব দিবস পালনের কোনো মানে হয় না, যদি না প্রবাসীদের সমস্যাগুলোর সমাধান করা হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপ অনুযায়ী, দেশের এক কোটির মতো মানুষ বিদেশে বসবাস করছেন, যাঁদের বেশির ভাগই মধ্যপ্রাচ্যে স্বল্প দক্ষ অথবা অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।

অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, প্রবাসীদের সমস্যাগুলো স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে ভাগ করে সমাধানের পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। কিন্তু সেসব সমস্যার কোনো সমাধান হচ্ছে না। তিনি প্রবাসীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সরকারকে বেশি মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন।