বাঁশের যে সামগ্রী ছাড়া চাকমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হয় না

ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পসামগ্রী ফুলবারেং বুনছেন বৃদ্ধ শিব শংকর তালুকদার । সম্প্রতি খাগড়াছড়ির পানছড়ির রবি কৃষ্ণ কার্বারিপাড়ায়প্রথম আলো

বিয়ের বাদ্য বাজলেই খোঁজ পড়বে ফুলবারেংয়ের। চাকমা সমাজে অন্যতম এই অনুষঙ্গ ছাড়া প্রাচীনকালেও বিয়ে হতো না, এখনো হয় না। এটি মূলত কারুকার্যখচিত বাঁশের তৈরি ঝুড়ি। ওপরে সুদৃশ্য ঢাকনা থাকে। বিয়ের দিন বরের বাড়ি থেকে কনের জন্য অলংকার, পোশাক -পরিচ্ছদ, সাজসজ্জার সরঞ্জাম—সবই নেওয়া হয় ফুলবারেংয়ে করে। তবে বর্তমানে এটি গৃহসজ্জার শৌখিন সামগ্রী হিসেবেও অনেকে ব্যবহার করেন। ঘর সাজানোর জন্য বিদেশেও রপ্তানি হয় অনন্য এই হস্তশিল্পের।

ফুলবারেং তৈরি যেমন সহজ নয়, তেমনি সহজে এটি বাজারে মেলেও না। এ জন্য আগে থেকে কারিগরদের অর্ডার করতে হয়। পাতলা বাঁশের ফালি দিয়ে জটিল বুননে তৈরি এক একটি ফুলবারেং বিক্রি হয় তিন থেকে চার হাজার টাকায়। খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার লোগাংয়ের রবি কৃষ্ণ কার্বারিপাড়ার বৃদ্ধ শিব শংকর তালুকদার ফুলবারেং তৈরি করে সংসার চালান। ছোটবেলা থেকেই শিব শংকর বাঁশের কাজ করেন। তবে ফুলবারেং বানাচ্ছেন ১৫ বছর ধরে। ১০ বছর ধরে ভারী কাজ করতে পারেন না বলে ফুলবারেংসহ বাঁশের হস্তশিল্পসামগ্রী তৈরি করেই তাঁর সংসার চলে।

পানছড়ি বাজার থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে রবি কৃষ্ণ কার্বারিপাড়া। সেখানে একটি পাহাড়ের ওপর শিব শংকর তালুকদারের মাটির বাড়ি। সম্প্রতি তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, চিকন করে কাটা বাঁশের ফালি উঠানের চারদিকে ছড়ানো। এক পাশে বসে কেটে রাখা এসব বাঁশ দিয়ে ফুলবারেং বুনছেন বৃদ্ধ শিব শংকর। চারপাশে রাখা আছে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি ফুলবারেং। একসময় জেদের বশে শিখেছিলেন ফুলবারেং তৈরি। বর্তমানে ফুলবারেং তৈরি করেই চলাচ্ছেন সংসার। বর্তমানে তাঁর হাতে বোনা ফুলবারেং যাচ্ছে দেশ-বিদেশে।

৭৭ বছর বয়সী শিব শংকরের দুই ছেলে। কাজ করতে করতেই শিব শংকর বলে চললেন তাঁর কাজের কথা। তিনি বলেন, ‘একসময় এখনকার মতো প্লাস্টিক ছিল না। হাটবাজারও ছিল অনেক দূরে দূরে। ছোটবেলায় দেখতাম, সবাই প্রয়োজনীয় জিনিস বাঁশ দিয়ে নিজেরাই তৈরি করতেন কিংবা গ্রামের অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে দিয়ে বানিয়ে নিতেন। গ্রামের সবার ঘরেই থাকত বাঁশের তৈরি ধান রাখার খারাং, লেই, ধান শুকানোর তলই (পাটি)। তবে নতুন শিশু জন্মালে দোলনা আর গ্রামে কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান হলেই ফুলবারেং তৈরি করা হতো এলাকার সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে দিয়ে। এগুলো আমার খুব পছন্দের ছিল। বাপ-দাদাদের দেখতাম, অবসর সময়ে এসব বুনতেন। তাঁদের দেখতে দেখতে শেখা হয়। এসব সামগ্রী তৈরি করতে মিতিংগা, ঢোল, মুলি—এই তিন ধরনের বাঁশ ব্যবহার করতে হয়।’

শিব শংকর তালুকদার আরও বলেন, ১৫ বছর আগের এক বিয়ের সময় বরপক্ষের লোকজন ফুলবারেংয়ের খোঁজ করে পাচ্ছিলেন না। সে সময় বরপক্ষের লোকজন তাঁর কাছে আসেন। তিনি রাতদিন পরিশ্রম করে তিন দিনের মাথায় ফুলবারেং তৈরি করে দেন। সেই ফুলবারেং পছন্দ হয় সবার। এর পর থেকে অনেকে অর্ডার করতে থাকেন তাঁর কাছে। তবে তখনো তিনি শখের বশে বুনে দিতেন ফুলবারেং। ১০ বছর ধরে ভারী কাজ করতে না পারায় ফুলবারেং বিক্রি করে সংসারের খরচ চালাচ্ছেন তিনি। এক একটা ফুলবারেং বিক্রি করেন ২ হাজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার টাকায়। কেউ অর্ডার করলে তাঁদের পছন্দ অনুযায়ী বাঁশের অন্য জিনিসও বানিয়ে দেন তিনি।

শিব শংকর তালুকদার আক্ষেপ করে বলেন, এখনকার ছেলেমেয়েদের বাঁশের কাজ শিখতে কোনো আগ্রহ নেই। তাঁর দুই ছেলে বাঁশ চিরতেও পারে না। খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, উপজেলাজুড়ে কেউ ফুলবারেং বুনতে পারে না। মাঝেমধ্যে ভাবেন, তিনি চলে গেলে ফুলবারেং কীভাবে সংগ্রহ করবে লোকজন। একসময় হয়তো হারিয়েই যাবে ফুলবারেং।

পানছড়ি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সর্বোত্তম চাকমা বলেন, শিব শংকর তালুকদার খুব সুন্দর করে বাঁশের বিভিন্ন জিনিস তৈরি করেন। বিশেষ করে ফুলবারেং তিনি ধরে রেখেছেন। তাঁর ফুলবারেংয়ের চাহিদা রয়েছে দেশে-বিদেশে।