ফি বাড়াল বিআরটিএ, ব্যয়ের বোঝা চাপল যানবাহনে

নিজেদের ব্যয় বাড়ায় মালিকেরা নতুন করে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর তৎপরতা শুরু করতে পারেন
ফাইল ছবি

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ৫১টি সেবার মূল্য বা ফি ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে সরকার। এতে ব্যক্তিগত যানবাহনের মালিকদের ব্যয় যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে ভাড়ায় চালিত যানের খরচ। নিজেদের খরচ বাড়লে পরিবহনমালিকেরা ভাড়াও বাড়িয়ে দিতে পারেন।

জ্বালানি তেলের দাম গত বছর আগস্টে রেকর্ড হারে বাড়ানোর পর যানবাহনের ভাড়া বেড়েছে। এদিকে বাজারে চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপক চড়া। এরই মধ্যে যানবাহনের পেছনেও মানুষের ব্যয় বাড়িয়ে দিল সরকার।

বিআরটিএর কাছ থেকে সাধারণ মানুষকে ৫৩ ধরনের সেবা নিতে হয়। এর মধ্যে ৫১টির ফি বাড়ানো হয়েছে। বৃদ্ধির সর্বনিম্ন হার প্রায় ১৩, সর্বোচ্চ ৩০০। ১২টি সেবার মূল্য ১০০ শতাংশের বেশি বাড়ানো হয়েছে। আর ১০টি সেবার ক্ষেত্রে নতুন ফি আরোপ করা হয়েছে। শুধু মোটরসাইকেল ও অসমর্থ ব্যক্তির উপযোগী মোটরযানের নিবন্ধন ফি বাড়েনি।

এর বাইরে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য তহবিল গঠনের লক্ষ্যে যানবাহনমালিকদের এককালীন অর্থ দিতে হবে। বাস-ট্রাকের জন্য তা ১ হাজার ৫০০ টাকা, ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা, তিন চাকার মোটরযানের ক্ষেত্রে ৩০০ টাকা ও মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে ১ হাজার টাকা।

সেবামূল্য বাড়িয়ে সরকার গত ২৭ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন বিধিমালা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করে। গত রোববার থেকে বাড়তি ফি আদায় শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে মোটরযানের জন্য নিবন্ধন; ফিটনেস সনদ ও চালকের লাইসেন্স প্রদান, যানবাহনের মালিকানা বদলি, চলাচলের অনুমতি—এমন ৫৩ ধরনের সেবা কিংবা কাজ করাতে বিআরটিএতে যেতে হয়।

দেশে যেসব মোটরযান আছে, সেগুলো মোটাদাগে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হচ্ছে—১. ব্যক্তিগত মোটরযান, ২. ব্যক্তি বা কোম্পানির অধীন পরিচালিত যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী যান, ৩. ভাড়ায় চালিত গণপরিবহন।

ব্যক্তিগত যানবাহন ও এর চালকের ব্যয় বৃদ্ধি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের খরচের বোঝা ভারী করে। আর গণপরিবহনের খরচ বৃদ্ধির বিষয়টি সব সময়ই ব্যবহারকারী, অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপে। একবার বাস ও ট্রাকের ভাড়া বৃদ্ধির পর বাড়তি খরচের ধুয়া তুলে ইতিমধ্যে গণপরিবহনমালিকেরা ভাড়া বৃদ্ধির সুর তুলতে শুরু করেছেন। এমনটা হলে আরেক দফা চাপে পড়বে সাধারণ মানুষ।

বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে সারা দেশে নতুন করে মোটরযানের নিবন্ধন হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার। চালকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে ৭ লাখ ৮৪ হাজার। ফিটনেস সনদ নবায়ন করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার যানবাহনের। ২ লাখ ৫ হাজার যানবাহন চলাচলের অনুমতি (রুট পারমিট) দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে বিআরটিএ গত অর্থবছরে বিভিন্ন কর ও ফি বাবদ মানুষের কাছ থেকে ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি আদায় করেছে। ফি বাড়ানোর ফলে যানবাহন থেকে সরকারের আয় আরও বাড়বে।

বাড়তি টাকা দিলেও মানুষ বিআরটিএর কাছ থেকে সহজে ও দুর্নীতিমুক্ত সেবা পাবে কি না, সে প্রশ্ন রয়ে গেছে। যেমন এক মাসের মধ্যে চালকের লাইসেন্স দেওয়ার কথা থাকলেও ২০১৯ সালের পর তিন বছরে লাইসেন্স না পাওয়ার নজির আছে। সব কাজে দালালদের দৌরাত্ম্য ও ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ পুরোনো।

বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মাহবুব-ই-রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, মোটরযানের ফি তারা শুধু আদায় করেন। ফি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। তিনি জানান, বিআরটিএর সেবার ফি ২০১৪ সালের পর এবারই বাড়ল।

লাইসেন্সের ব্যয় কতটা বাড়বে

নিরাপদ সড়কের জন্য দরকার লাইসেন্সধারী দক্ষ চালক। দেশে যানবাহনের তুলনায় লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা কম। তাই সড়ক নিরাপদ করতে লাইসেন্সধারী দক্ষ চালকের সংখ্যা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়ার কথা বলেছে সরকার। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যয় বেড়েছে ব্যাপকভাবে।

একটি লাইসেন্সের আবেদন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে ৯ ধরনের ফি রয়েছে—শিক্ষানবিশ লাইসেন্স, শিক্ষানবিশ লাইসেন্স নবায়ন, প্রতিবার দক্ষতা যাচাই পরীক্ষা (অকৃতকার্য হলে), লাইসেন্স ইস্যু ফি, বার্ষিক লাইসেন্স ফি, বার্ষিক বিলম্ব ফি, ঠিকানা পরিবর্তন, শ্রেণি বা ধরন পরিবর্তন, প্রতিলিপি ফি ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে ব্যয় বেড়েছে ৩৩ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত।

সব মিলিয়ে এক ব্যক্তির এখন শিক্ষানবিশ থেকে শুরু করে অপেশাদার লাইসেন্সের স্মার্ট কার্ড নিতে সাড়ে ৩ হাজার টাকার মতো লাগবে, যা এত দিন ৩ হাজার ১০০ টাকায় হয়ে যেত।

যানবাহনমালিকদের খরচ

যানবাহনের নিবন্ধনের ফি ছাড়াও প্রতিবছর এর মালিকদের সড়ক কর, অগ্রিম আয়করসহ নানা কর দিতে হয়। মাঝেমধ্যেই তা বাড়ানো হয়। ভাড়ায় চালিত যানবাহনের ক্ষেত্রে বাড়তি হিসেবে চলাচলের অনুমতিসহ বিভিন্ন খাতে বাড়তি খরচ করতে হয়।

দেশে এত দিন ১ হাজার ৪০০ সিসির (ইঞ্জিন ক্ষমতা) একটি সেডান কারের (প্রাইভেট কার) নিবন্ধন ফি ছিল ৪৯ হাজার টাকা, যা বাড়িয়ে ৬০ হাজার টাকা করা হয়েছে। ভাড়ায় চালিত যাত্রীবাহী ৫২ আসনের একটি বাসের নিবন্ধন ফি ২৫ হাজার টাকা করা হয়েছে, যা ছিল ১৭ হাজার ২৫০ টাকা। আন্তজেলা পরিবহনের চলাচলের অনুমতির ফি শ্রেণিভেদে ছিল বছরে ৫২০ থেকে ১ হাজার ৬৯০ টাকা। এখন তা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা।

ব্যক্তিগত গাড়ি বা যানের মালিককে নিবন্ধনের বাইরেও সড়ক ব্যবহারের কর, আয়কর, মালিকানা বদলি, দলিলাদি হারিয়ে গেলে পুনরায় তোলা এবং ফিটনেস সনদের জন্য ফি দিতে হয়। অন্যদিকে, ভাড়ায় চালিত যানবাহনের ক্ষেত্রে বাড়তি হিসেবে তাঁদের চলাচলের অনুমতিসহ বাড়তি খরচ করতে হয়।

নতুন ফি

গণপরিবহন চালানোর জন্য চালককে লাইসেন্সের পাশাপাশি অনুমোদন নিতে হবে। দিতে হবে ৫০০ টাকা। সড়ক আইন ভেঙে নম্বর কাটা গেলে পুনর্বিবেচনার জন্য ২০০ টাকা দিয়ে আবেদন করা যাবে। যানবাহনে বিজ্ঞাপন প্রচার করলে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা ফি দিতে হবে। মোটরযান মেরামত কারখানা বা ওয়ার্কশপ, মোটর ড্রাইভিং স্কুলের নিবন্ধন নবায়ন, স্কুল পরিদর্শন, বিআরটিএ থেকে পরিচিতমূলক পুস্তিকা সংগ্রহ, কন্ডাক্টরের লাইসেন্সের প্রতিলিপি উত্তোলনে নতুন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, গণপরিবহনের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও উপকরণের দাম বেড়েছে। সরকারও ফি বাড়াল। এখন বাসের ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে চিঠি লিখতে হবে। ভাড়া বাড়ালে মানুষ দিতে পারবে কি না, সেটাও ভাবতে হবে। পরিবহনমালিকেরাও তো লোকসান দিতে পারবেন না। এটা জটিল সমস্যা।