যথাযথ বিকল্প না থাকায় এনআইডি সার্ভার নিয়ে ঝুঁকি

ডিআরএস বা বিকল্প সংরক্ষণব্যবস্থা না থাকায় কোনো কারণে এনআইডির তথ্যভান্ডার নষ্ট হলে বিপুলসংখ্যক মানুষের তথ্য আর না পাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

দেশের প্রায় ১২ কোটি নাগরিকের ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্য রয়েছে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সার্ভারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই তথ্যভান্ডারের কোনো ডিজাস্টার রিকভারি সাইট (ডিআরএস) বা যথাযথ ব্যাকআপ (বিকল্প সংরক্ষণব্যবস্থা) নেই। ডিআরএস না থাকায় জাতীয় এই তথ্যভান্ডার অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সম্প্রতি ইসির তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ কমিটির একটি বৈঠকে বিষয়টি উঠে আসে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এনআইডির তথ্যভান্ডারে প্রায় ১২ কোটি ভোটারের কমবেশি ৩০ ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য আছে। ১৭১টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইসির এই তথ্যভান্ডার থেকে প্রতিনিয়ত তথ্য যাচাই–সংক্রান্ত সেবা নিচ্ছে।

ইসির কাছ থেকে এই সেবা নেয় এমন একটি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থেকে সম্প্রতি লাখ লাখ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়। এরপর দেশে ডিজিটাল তথ্য ব্যবস্থানায় নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়টি আলোচনায় আসে।

ডিআরএস না থাকায় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো কারণে যদি এনআইডির তথ্যভান্ডার নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে বিপুলসংখ্যক মানুষের তথ্য আর না পাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। অনেক দিন ধরে এই বিকল্প সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালুর (ব্যাকআপ) কথাবার্তা চললেও এখনো তা পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি। এখন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে (বিসিসি) তথ্যের ব্যাকআপ রাখা হয়, কিন্তু ইসির কর্মকর্তারা মনে করেন তা যথাযথ নয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ৪ জুন ইসির জাতীয় পরিচয়পত্র, ভোটার তালিকা ও নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ কমিটির একটি সভা হয়। ওই সভায় জাতীয় তথ্যভান্ডারের ঝুঁকির বিষয়টি তুলে ধরেন ইসির আইডেনটিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং অ্যাকসেস টু সার্ভিসেস (আইডিইএ) প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সায়েম। এই প্রকল্পের মাধ্যমে স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্রের কাজ করা হয়।

ডিআরএস তো থাকতেই হবে। এটা যথাযথভাবে না থাকাটা অবশ্যই একটা ঝুঁকি।
আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সায়েম, প্রকল্প পরিচালক, আইডিইএ (দ্বিতীয় পর্যায়)

প্রকল্প পরিচালক ওই বৈঠকে বলেন, বর্তমানে বিকল্প কোনো ডিআরএস না থাকায় জাতীয় তথ্যভান্ডার অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তিনি ওই সভায় জানান, গাজীপুরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে জাতীয় তথ্যভান্ডারের শুধু নিরাপদ ডেটা ব্যাকআপ নিশ্চিত করার জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। চুক্তি সম্পাদন হলে সীমিত আকারে ডিআরএস কার্যক্রম চালু হবে। তবে জরুরি ভিত্তিতে জাতীয় তথ্যভান্ডারের জন্য অ্যাকটিভ ডিআরএস (একই সঙ্গে দুটি সার্ভারই চালু থাকা) স্থাপনে উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।

বৈঠকে তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ কমিটির সভাপতি নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান জাতীয় তথ্যভান্ডারের ভৌত এবং তথ্য ও সাইবার নিরাপত্তা অতিদ্রুত নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো কারণে সার্ভার ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশের সার্বিক ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা বিপর্যস্ত হতে পারে।

জানতে চাইলে আইডিইএ প্রকল্পের পরিচালক আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সায়েম প্রথম আলোকে বলেন, ডিআরএস স্থাপনের কাজ চলছে। এখন যে একেবারে বিকল্প সংরক্ষণ (ব্যাকআপ) নেই তা নয়। বিসিসিতে ডিজাস্টার রিকভারি আছে। তবে সেটা যথাযথ নয়। ডিআরএস স্থাপনের জন্য ইতিমধ্যে গাজীপুরে স্পেস ভাড়া নেওয়া হয়েছে। সেখানে শিগগির ডিআরএস স্থাপন করা হবে। এখানে ডিআর হবে; কিন্তু অ্যাকটিভ ডিআরএস হবে না। এ ছাড়া কুমিল্লায় একটি ডিআরএস স্থাপনের জন্য প্রক্রিয়া চলছে।

এনআইডির তথ্যভান্ডারে প্রায় ১২ কোটি ভোটারের কমবেশি ৩০ ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য আছে। ১৭১টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইসির এই তথ্যভান্ডার থেকে প্রতিনিয়ত তথ্য যাচাই–সংক্রান্ত সেবা নিচ্ছে।

জাতীয় এই তথ্যভান্ডারের ডিআরএস না থাকা ঝুঁকিপূর্ণ কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ডিআরএস তো থাকতেই হবে। এটা যথাযথভাবে না থাকাটা অবশ্যই একটা ঝুঁকি।

২০০৭ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করে এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। ভোটারদের জাতীয় পরিচয়পত্রও (এনআইডি) দেওয়া হয়। এখন ভোটারের নাম, মা–বাবার নাম, ঠিকানা, জন্মতারিখ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ছবিসহ কমবেশি ৩০ ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ভোটারের আঙুলের ছাপ ও চোখের মণির ছাপ (আইরিশ), ডিজিটাল সইও নেওয়া হয়। এসব তথ্য ইসির এনআইডি সার্ভারে সংরক্ষিত থাকে।

আরও পড়ুন

ইসির সূত্র জানায়, শামসুল হুদা কমিশন গাজীপুর ও যশোরে ব্যাকআপ সার্ভার করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত এটি কার্যকর হয়নি। ডিআরএস স্থাপনে বাংলাদেশ ডেটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করতে ৯ জুলাই তিন কর্মকর্তাকে মনোনীত করেছে ইসি।

তথ্যপ্রযুক্তিবিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির প্রথম আলোকে বলেন, এনআইডি সার্ভার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকিং কার্যক্রম থেকে শুরু করে সিম বিক্রি—নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে এখান থেকে প্রতিনিয়ত সেবা নেওয়া হয়। এ ধরনের একটি তথ্যভান্ডারের জন্য ডিআরএস আবশ্যক, এর কোনো বিকল্প নেই। যদি এনআইডি সার্ভারের ডিআরএস না থাকে, তাহলে তা ভয়াবহ বিপজ্জনক। এ ধরনের তথ্যভান্ডারের জন্য একটি আলাদা জায়গায় লাইভ ব্যাকআপ (একই সঙ্গে দুটি সার্ভারই চালু থাকা) থাকতেই হবে। যাতে কোনো কারণে একটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে অন্যটি দিয়ে কাজ চালানো যায়।

আরও পড়ুন