বনের পিপাসার্ত প্রাণীরা

পাবনা শহরের মহেন্দ্রপুর এলাকার একটি ছাদে এক থালা পানি পেয়ে বুলবুলি গোসল সারছেছবি: সামিউল আহসান

মার্চের শেষভাগ। বেশ গরম পড়েছে। তপ্ত দুপুরে আমাদের নৌকাটা সুন্দরবনের ভদ্রা খালের দিকে যাচ্ছে। বিকেলে আবহাওয়া খারাপ হওয়ার শঙ্কায় আমরা বন বিভাগের ক্যাম্পে আশ্রয় নিলাম। একটুখানি বৃষ্টি হলো। প্রচণ্ড গরম কিছুটা হলেও কমল। একটি কাঠঠোকরাকে দেখলাম বৃষ্টির আটকে পড়া পানিতে গোসল করতে।

বৃষ্টির ভেতর এক জোড়া বাদামিপাখ মাছরাঙার ডালে বসা খুনসুঁটিও নজরে পড়ল। সুন্দরবনের চারদিকে শুধু পানি আর পানি অথচ এখানে খাওয়ার পানির বড়ই অভাব। শুধু বুনো প্রাণীই নয়, এ বনের ভেতর যে বনকর্মী ও জেলেরা বাস করেন, তাঁদেরও বেশির ভাগই পুকুরের পানি পান করেন। কোনো কোনো জায়গায় আবার বৃষ্টির পানি ধরার ব্যবস্থা আছে। সেই পানিও পান করা হয়।

ভদ্রা বন ক্যাম্পের পাশে বন অধিদপ্তর একটি পুকুর খনন করেছে। এই পুকুরের মিঠাপানি মানুষের পাশাপাশি অন্য প্রাণীগুলোও ব্যবহার করে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বাঘের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।

রাতের বেলা পুকুরের পানি খেতে আসে। বাঘের পায়ের ছাপ দেখেই তা অনুমান করা যায়। হরিণের দলও প্রতিদিনই নিয়মিত পানি খায়। চেনা-অচেনা সব বুনো প্রাণীই এই পুকুরের পানি পান করে জীবন বাঁচায়। ভদ্রার মতো সুন্দরবনে প্রায় শতাধিক মিঠাপানির উৎস আছে। সুন্দরবনের যেখানেই মিঠাপানির উৎস আছে, সেখানেই বাঘ, হরিণসহ অন্যান্য প্রাণীর চলাফেরা বেশি।

সুন্দরবনের এই যাত্রায় ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে ছিলেন আমার অস্ট্রেলিয়ান কুমির–গবেষক বন্ধু রুচিরা সামারাবিরা। তিনি আমাকে বললেন, লোনাপানির কুমিরও নাকি মিঠাপানি পান করে। বৃষ্টি হলে পানির ওপর একটি মিঠাপানির সূক্ষ্ম আস্তরণ তৈরি হয়। সেখান থেকে কুমিরগুলো পানি পান করে।

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে উত্তরের একটি শালবনে গেলাম। সকাল সকাল বেশ কয়েক জাতের পাখির দেখা পেলাম। এর মধ্যে ফ্যানটেল অন্যতম। একটু বেলা বাড়লে আর কোনো পাখির শব্দ নেই। প্রচণ্ড গরম আর তাপে পাখিগুলোর চলাফেরা কমে গেছে। পাখির এই নিস্তব্ধতায় আমারও গলাটা শুকিয়ে এল। সঙ্গে রাখা পানির বোতলে গলাটা ভিজিয়ে নিলাম ঠিকই কিন্তু মনের ভেতর কেমন যেন ভর করল এই ভেবে যে পাখিগুলো কীভাবে গলা ভেজাবে!

এ দেশের বেশির ভাগ বনেই কিন্তু বুনো প্রাণীর জন্য আমরা পানির উৎস নিশ্চিত করতে পারিনি। সব সময়ই পশুপাখি প্রাকৃতিক পানির ওপর নির্ভর করে। পাহাড়ি বনের হাতিগুলো দল বেঁধে পানি পান করতে লোকালয়ে নেমে আসে শুষ্ক মৌসুমে। এ সময় ঝরনা আর ঝিরিগুলো শুকিয়ে পড়ে। বেশির ভাগ প্রাণীরই এ সময় পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়। শুধু পানির কারণেই বন্য প্রাণী আর মানুষের মধ্যে দিন দিন সংঘাত বাড়ছে।

দিন দিন খরার প্রভাব তীব্র হচ্ছে। এতে মানুষের চেয়ে অনেক বেশি বিপদে পড়ছে প্রাণীগুলো। প্রাণীদের তো আর পানির উৎস নিশ্চিত করার মতো সক্ষমতা নেই। তাই অনেক প্রাণী তাদের প্রিয় আবাসস্থল ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। আবার কোনো কোনো প্রাণী হারিয়েই যাচ্ছে প্রকৃতি থেকে। এ দেশে বন জরিপ হয়তো কিছুটা হয়েছে। কিন্তু বনের ভেতর পানির উৎস জরিপ এখনো হয়নি। কাজটি শিগগিরই করে পানির সমাধান কিছুটা হলেও করতে হবে।

এপ্রিলের মধ্যভাগে হিট ওয়েভ শুরু হলো। অনেক জায়গায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়াল। বৃষ্টির দেখা নেই। পাখিপ্রেমী সামিউল আহসান ফোন করে জানালেন, তাঁর বাড়ির ছাদে কয়েকটি জায়গায় পাখির জন্য পানি রাখার ব্যবস্থা করেছেন। তিনি পাবনা শহরের অদূরে মহেন্দ্রপুরে থাকেন। আর তাতে বিভিন্ন জাতের পাখি এসে সিরিয়াল ধরে গোসল সারছে। প্রতিদিন প্রায় আট জাতের পাখি আসে। বুলবুলি, শালিক, মুনিয়া, ফিঙে, কাকের দেখা প্রায় প্রতিদিনই পান। মনের আনন্দে দিনে দুবার পাত্রের পানি পরিবর্তন করেন যেন পাত্রে মশার উৎপাদন না হয়। আমরাও সবাই কিন্তু পারি ব্যালকনি অথবা ছাদে এভাবে এক বাটি পানি রেখে দিতে। তাতে অন্তত দু–একটি পাখিও তার তৃষ্ণা মেটাতে পারবে। বন কিংবা শহরের পিপাসার্ত প্রাণীগুলো নিরাপদ পানির উৎস খুঁজে পাবে—এ আশাই করি।

  • লেখক, বন্য প্রাণী গবেষক