চৈত্রের অভিলাষ

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

দিনের আলো যায় যায়। আধা শোয়া জামিল চৌধুরীর উঠে গিয়ে আলো জ্বালতে ইচ্ছা করে না। চোখের সামনে ঘরের বাতাসে যেন কালি মেখে দেয় কেউ। কালির পোঁচ বাড়তে থাকে। বিড়াল যেমন অন্ধকারে দেখে, আজকাল জামিল চৌধুরীর মনে হয়, তিনিও অন্ধকারে দেখতে শুরু করেছেন। এর একটা কারণ হতে পারে তিনি সামনে নয়, তাকিয়ে থাকেন পেছনের দিকে। ৭৯ বছর বয়সে স্মৃতির ভার বাড়ে। তাই সবকিছু চোখ বন্ধ করেই দেখা যায়। যে অতীত আগে ঘাঁটা হয়নি, তা-ও যেন এখন একের পর এক পরত খুলে খুলে দেখতে সাধ হয়।

মাঝেমধ্যে কিছু আলোচনা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পান তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের স্মৃতিচারণা তখন মুখ্য হয়ে ওঠে। স্মৃতি ঘাঁটার এই অভ্যাস তার কারণেই হবে হয়তো। তবে শুধু স্মৃতিচারণা নয়, অনুষ্ঠানগুলোতে উৎসুক তরুণেরা তাঁকে হাস্যকর কিছু প্রশ্নও করে, স্বাধীন দেশটা কেমন চেয়েছিলেন? মানে যে বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন, তা কি পেয়েছেন? এখনকার অবক্ষয় আর অনিয়ম দেখলে কি আপনার যুদ্ধে জীবন বাজি রাখার জন্য আফসোস হয়? এসব প্রশ্ন যে তাঁকে বিব্রত করে, বোকা তরুণেরা তা জানে না। ওরা যেকোনো পরিশ্রমকে হুট করে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ বলে ফেলে। যেকোনো শত্রুকে অবলীলায় বলে ‘রাজাকার’। জামিল চৌধুরীর মাথা গরম হয়ে যায় এসব শুনলে, চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে, সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধ কী, তা তোমরা জানো? নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় আস্ত অস্তিত্বটাই বাজি রাখা কতটা অনিশ্চয়তার, ভেবে দেখেছ কখনো? আর ওই রাজাকার আমাদের কতটা ক্ষতি করেছিল, তোমাদের কোনো ধারণা আছে? তাদের আবেগের সামনে কথাগুলো বলতে পারেন না। মনে আছে, একসময় মনে হতো, তাদের সত্যিকারের যুদ্ধ পাকিস্তানিদের সঙ্গে নাকি এই দেশি গাদ্দারদের সঙ্গে? মনের মধ্যে খচখচ করে যে এত বছর পরে সে রকম একটা রাজাকারের স্মৃতিও তাঁকে দুঃস্বপ্নে তাড়া করে।

একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে জামিল চৌধুরীর বুক থেকে। আর মাত্র কয়েকটা বছর! তারপর আর কেউ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করতে ডাকবে না কাউকে। স্মৃতির ভান্ডার নিয়ে সাহসী মানুষগুলো একের পর এক বয়সী হয়ে মৃত্যুর স্বাদ নেবে। তাই হয়তোবা যা বলার বলে যাওয়াই ভালো।

খাবার ঘরে আলো জ্বলছে। ইজি চেয়ার থেকে উঠে তিনি সেদিকে হাঁটেন। রান্নার মেয়েটা পা ছড়িয়ে তার আধা সেলাই করা কাঁথা মেলে বসেছে। একজন মানুষের রান্না, অনেক সময় হাতে থাকে। তিনি কাছে গিয়ে তার হাতের কাজ দেখেন। ধারের দিকে সুতার লম্বা রেখা টানছে। কাঁথায় ফোঁড় তুলতে তুলতে সে আপনমনে হাসে। ছোট জীবনে তারও কি অনেক স্মৃতি? তিনি সুচের গতিপথ অনুসরণ করেন। মেয়েটা বলে, ‘কী দেখেন, মামা?’

‘এই যে তুমি সুচ ওপর থেকে কাঁথায় ফোঁড়ালে, সামনে নিয়ে ওপরে আনলে, তারপর একটু পেছনে নিয়ে আবার ফোঁড়ালে, তারপর আরও সামনে নিলে—এটা দেখছি। একবার সামনে আগানো, তারপর পেছনে যাওয়া, তারপর আবার সামনে, এ–ই তো?’

‘জি, তয় এইটা দেখনের কিছু নাই। এই সেলাইয়ের এইটাই নিয়ম।’

‘এটা দেখে আমার কী মনে পড়ল জানো?’

‘কী?’

‘যুদ্ধের সময়ে যখন আমরা কোনো মিশনে যেতাম, নিজেদের মধ্যে দুই দলে ভাগ হইয়া নিতাম। একদল প্রথমে আগাত, কিছুদূর যেত, তারপর সিগন্যাল দিয়ে দাঁড়ায়ে থাকত।’

‘সিগন্যাল মানে?’

‘এই মনে করো, শিস দিয়ে পাখির ডাক। শুনলে আরেক দল যাওয়া শুরু করত। আগের দলটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা পার হয়ে আরও কিছুদূর গিয়ে তারাও সিগন্যাল দিত। তখন পেছন থেকে প্রথম দল আবার আগাত। আমাদের যাওয়ার গতিপথটা ছিল ঠিক তোমার এই সেলাইয়ের সুচের মতো।’

‘এইরাম কেন করতেন, মামা? অনেক বেশি সময় লাগত না যাইতে?’

‘সময় লাগত। কিন্তু সামনে বা পেছন থেকে যদি শত্রু আক্রমণ করে, তাহলে যেন আরেক দল পেছন থেকে পাল্টা আক্রমণ করতে পারে, সে জন্য ওভাবে যেতে হতো।’

‘কেউ আক্রমণ করল শ্যাষে?’

‘করল কয়েকবার। পাহাড়ি ঝোপঝাড়, জঙ্গলের ভেতরে মুখোমুখি যুদ্ধও হলো।’

‘আপনে তহন সামনে আছিলেন?’ সেলাই থামিয়ে চোখ বিস্ফারিত হয় মেয়েটার।

‘না, পেছনের দলে ছিলাম। যতটা সময় পরে সামনের লোকেরা সিগন্যাল দেবে, তার ঠিক আগমুহূর্তে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। গুলির শব্দে শুয়ে পড়লাম। আক্রমণ করার জন্য মাটিতে ছেঁচড়ে আগাতে লাগলাম। দু-তিন সেকেন্ড পরে গাছের ডালে বাড়ি খেয়ে ধুপ করে কী যেন পড়ল। দেখি, একটা রক্তমাখা হাত। একপলকেই চিনতে পারলাম, আমার বন্ধু সগীর মাস্টারের হাত সেটা। হাতের কবজিতে গোল সাদা ডায়ালের ঘড়িটা অনেক দিনের চেনা। বিস্ফোরণের ধাক্কায় হাত শরীর থেকে ছুটে গেছিল। উড়ে আসছে কিন্তু তখনো আঙুলগুলো সামান্য নড়ছিল। ইচ্ছা হলো হাতটা একটু ধরি...’

‘আপনার বন্ধু মারা গেলেন?’

‘না। আমরা তাদের সীমানায় ঢোকার আগেই অল্প কয়েকজন সেনা আক্রমণ করেছিল। পেছন থেকে আমাদের আরেক দল পাল্টা আক্রমণ করায় সব মারা পড়ল। সগীর অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল। সেনাদের বেশ কয়েকজনের গায়ে গুলি লেগেছিল। ওদিকে গুলির শব্দে আস্তানার সেনারা সতর্ক হয়ে যাওয়ায় সেদিনের মিশন আর শেষ হয়নি। সগীরকে ঘাড়ে নিয়ে আমরা ফিরলাম। অনেক দিন পর সে সুস্থও হলো। শুধু একটা হাত ছিল না তার শরীরে। পায়ে আঘাত পাওয়ায় হাঁটতেও পারত না। তাঁবুর মধ্যে শুয়ে শুয়ে কাঁদত।’

‘হাতের কষ্টে কাঁদতেন তিনি?’

‘না। আমাদের সাথে মিশনে যেতে পারত না বলে। মিশন শেষে আমরা ফিরলে কাঁদত আর বলত, গুলি লাগার পরে আমারে উঠাইয়া আনলা ক্যান? আমারে ফেইলা চইলা আসো নাই ক্যান? আস্তানা বদলানোর সময় প্রতিবার বলত, আমারে আর টাইনো না, ফেইলা চইলা যাও। শেষে যখন সুস্থ হলো, তখন যুদ্ধ প্রায় শেষের দিকে।’

মেয়েটা কোলে নামিয়ে রাখা সেলাইয়ের কাঁথা হাতে নিয়ে বলে, ‘ভাগ্যিস যুদ্ধে উনার মতো আপনার কিছু হারায় নাই!’

মেয়েটার কথা শুনে জামিল চৌধুরী বিভ্রান্ত বোধ করেন। মনে মনে বলেন, হারায়নি! কিন্তু ধীরে ধীরে ৫০ বছরে যদি স্বাধীনতা পাওয়ার আনন্দটাই হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, তবে তাকে কি যুদ্ধে হারানো বলে? তিনি কি এখনো মুক্তিযুদ্ধে আছেন ওই অর্বাচীন তরুণগুলোর মতো? ছেলেমেয়েগুলো বিদেশে সংসার পাতল। স্ত্রীও গেল তাদের পেছনে পেছনে। কেন তারা আনন্দে থাকার জন্য এই দেশটাকে বেছে নিতে পারল না, যে দেশ পাওয়ার জন্য একদিন তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন! মুক্তিযুদ্ধ কি তবে সাধারণ একটা রাজনৈতিক ঘটনাই ছিল কেবল?

রাতে ঘুম আসে না বহুদিন হলো। ঘুমের ট্যাবলেট একটা থেকে দুটোয় উঠেছে। আবার চোখ লেগে এলেই আজব এক স্বপ্ন তাড়া করে। স্টেনগানের গুলি চলছে...ঠা ঠা ঠা ঠা...একদিন হাতে অস্ত্র ছিল বলে দেশের শত্রুকে মারতে এতটুকু দ্বিধা হতো না। এমনকি কোথাও কোনো রেকর্ডে না থাকলেও তার মন জানে, অস্ত্র হাতে থাকতে থাকতে প্রতিশোধের আগুনে বিজয়ের পরও

হন্যে হয়ে পরিচিত রাজাকারকে খাল-বিল পেরিয়ে খুঁজে বের করেছেন তিনি। কিন্তু এত বছর পর যুদ্ধের ওই একটা ঘটনা তাঁকে স্বপ্নে ভোগায় কেন, কে জানে।

যুদ্ধের সময় সিলেটে একবার টিলার ওপরে ঘাঁটি পড়ল। পাহাড়ের পায়ের কাছে গ্রাম। দলের তরুণ ছেলেরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলতে যেত, খবরাখবর আনত। গ্রামের কিছু রাজাকারের বিরুদ্ধে ছেলেরা নালিশ আনল। গ্রামের মানুষদের কাছে তারা ত্রাস। হিন্দুদের বাড়ি লুটপাট করে জ্বালিয়ে দিচ্ছে, তাদের পেলে হত্যা করছে আর মুসলমান মেয়েদের তুলে দিচ্ছে আর্মিদের হাতে। তাদের মদদে গ্রামে আর্মি আসে বারবার। রাজাকারগুলো কৃষকের খেতের ফসল ছিনিয়ে তুলে দিত আর্মিদের হাতে। কৃষকেরা প্রতিবাদ করলে গুলি খেত। তাদের ভয়ে গ্রামের মেয়েরা ঘরের মাচার ওপর দিনরাত লুকিয়ে থাকত। কেউ কেউ সীমানা পার হয়ে চলে যাচ্ছিল ভারতে।

বুক ফুলিয়ে চলা কয়েকটা রাজাকারকে একদিন ছেলেরা কায়দা করে ধরে আনল। পাহাড়ের ধার ঘেঁষে লম্বা লাইন করে তাদের দাঁড় করানো হলো। তাদের মধ্যে কেউ বয়স্ক, কেউ তরুণ। তারা ভাবত, আর্মিদের সাহায্য করে পুণ্যের কাজ করছে। আর ক্যাম্পের নিয়ম, ওখানেই শুনানি, ওখানেই রায়। লাইনে দাঁড় করানোর পর প্রথমে স্বীকারোক্তি। তারপর বিচারের রায়। তখন শাস্তি ছিল একটাই, রূপকথার গল্পের মতো—গর্দান। মনে আছে, ব্রাশফায়ার একবার শুরু করলে সহজে থামানো যেত না, সামনে যে থাকবে, সে–ই মারা পড়বে। জামিল চৌধুরীর হাতে স্টেনগান, রাজাকারের সারি থেকে একটার পর একটা শরীর ঘাসের ওপরে পড়তে লাগল। লাইনের শেষের দিকে একটা অল্প বয়সী ছেলে ছিল। স্বীকারোক্তির সময় অনেক কাঁদছিল, সে নাকি বুঝতে পারেনি। মাত্র তিন দিন হলো রাজাকারের দলে নাম লিখিয়েছে। তখন কে শোনে কার কথা। গায়ে গুলি লাগার আগেই সে গুলি খাওয়ার ভান করে শরীরটা মাটিতে ছেড়ে দিল। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে পাহাড় থেকে দিল লাফ। অনেক নিচে ঝোপঝাড়ের ওপরে পড়ল। ওপর থেকে তাকে দেখা যাচ্ছিল। জামিল চৌধুরীর মাথায় খুন চেপে গেল। মনে হলো, ওই পুঁচকে ছেলেটার কাছে তিনি হেরে গেছেন। সম্ভবত একটা বরইগাছের ওপরে পড়ছিল সে। দেখলেন, তার সাদা লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি কাঁটা আর ডালপালায় আটকে গেছে। নিজেকে সে ছাড়াতে পারছে না, প্রাণপণ দাপাদাপি করছে। অত উঁচু থেকে পড়াতে তার হাত–পা ভেঙে যাওয়ারও কথা। কথা নয়, অবশ্যই ভেঙেছিল। সে কারণেই সে গাছ থেকে নামতে পারছিল না।

ইজি চেয়ারে বসে এটুকু পর্যন্ত ভাবতে ভাবতে জামিল চৌধুরী চোখ বন্ধ করে ফেলেন। কিন্তু স্মৃতিতে পরের দৃশ্য ঠিকই রোমন্থিত হয়। বন্ধ চোখেই তিনি দেখেন, এতটুকু সময় নষ্ট না করে তিনি ওপর থেকে তাক করে গুলি করেন। করতে থাকেন যতক্ষণ স্টেনগান থামানো না যায়। দাপাদাপি করা শরীরটা ঝাঁঝরা করে দেন। খানিক আগে মাকড়সার মতো যে হাত-পাগুলো চারদিকে মেলা ছিল, সেই তড়পানো হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু জামিল চৌধুরীর মাথার ভেতরে গুলির শব্দ থামে না। তিনি মাথা এদিক–ওদিকে নাড়ান। মানসিক যন্ত্রণায় ‘আহ্ উহ্’ শব্দ করেন। মেয়েটা সেলাইয়ের কাঁথা ফেলে ছুটে আসে, ‘মামা, কী হইছে? আইজকাইল প্রায়ই কিন্তু আপনেরে এইরাম দেখি। হইছেডা কী, মামা?’

জামিল চৌধুরী চোখে জিঘাংসার বদলে আজ আফসোস দেখা যায়। হাঁপাতে হাঁপাতে ভাবেন, সত্যি অনেক বয়স হয়ে গেছে। পাগলামি করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে ভাঙচুর করে বিশাল এক পরিবর্তন আনার মতো তেজ আর নেই। কপালের ওপরে রাখা হাতের উল্টো পিঠে ঘাম মুছে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, ‘আমি তাকে গুলি না করলেও পারতাম, সে তো প্রায় মরেই গেছিল। অত ওপর থেকে পড়লে কেউ বাঁচে? কিন্তু আমি নিজেকে থামাতে পারিনি। খুনের নেশা চেপেছিল।’

‘কী বলতেছেন, মামা? কার কথা কন?’

‘ওই যে, এখনো যাকে স্বপ্নে দেখি, চার হাত-পায়ের এলোমেলো দাপাদাপি দেখি। আমার ঘুম ভেঙে যায়। যতবার ঘুম ভাঙে, আমার আফসোস হয়। আমি তাকে ওইভাবে গুলি না করলেও পারতাম। সে হয়তো বাঁচতেও পারত। খোঁড়ায়ে খোঁড়ায়ে ঠিকই গ্রামে পৌঁছে যেত। বাঁচার জন্য সে এত উঁচু থেকে লাফ মারল। লাইনে দাঁড় করানোর পর থেকে পায়ে ধরে মাফ চাওয়ার জন্য বারবার নিচু হচ্ছিল। বুকে গুলি করব বলে আমি ধমকে বলেছিলাম, ওই হারামজাদা, সোজা হইয়া দাঁড়া! কিন্তু লাফ দেওয়ার পর তখন তার প্রাণটা ভিক্ষা দিলেও বোধ হয় পারতাম।’

মেয়েটা ছুটে গিয়ে পানি আনে, দাবির সুরে বলে, ‘একটা মানুষ কবে মইরা ভূত হইছে আর আপনে অহন তরি তারে নিয়া পইড়া আছেন। পানি খাইয়া বিশ্রাম নেন, মামা।’

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে কথা বলতে গিয়ে একটা রাজাকারকে মারার দুঃসহ স্মৃতিজনিত মানসিক কষ্টের গল্প বলা যায় না। কিন্তু খুনোখুনির শব্দ আর রক্তের গন্ধ ছাড়া আজকাল মুক্তিযুদ্ধকে ভাবতেই পারেন না জামিল চৌধুরী। দেশটাকে যেভাবে কল্পনা করেছিলেন, তেমনটা হলেও কি তাঁর এসব কষ্ট থাকত? এ জন্যই কি তরুণেরা জানতে চায়, অবক্ষয় দেখলে প্রাণ বাজি রাখার জন্য আফসোস হয় কি না? তরুণেরা হয়তো কখনো কখনো ভেবেচিন্তেই প্রশ্ন করে। এটাই সম্ভবত জেনারেশন গ্যাপ, যে কারণে তিনি তরুণদের মনোভাব বুঝতে পারেন না। এসব ভাবতে ভাবতে বিভ্রান্ত লাগে তাঁর। ক্লান্ত শরীরে তিনি অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠে বসেন। আয়োজকদের মধ্যে দুজন তরুণ তাঁকে নিতে এসেছে।

সম্মান আর শ্রদ্ধা জানানো শেষ হলে তারা গল্প করতে আরম্ভ করে। বিষয় কি বরাবরের মতো ঢাকার দূষণ, যানজট হয়ে শেষে সেই মুক্তিযুদ্ধই?

‘আচ্ছা, যুদ্ধের পর যে আপনারা যেভাবে বিচিত্র জায়গা থেকে এসেছিলেন, সেভাবেই যাঁর যাঁর স্থানে ছড়িয়ে গেলেন, একবারও মনে হয়নি যুদ্ধের পর দেশ গঠনে আপনাদের ভূমিকা থাকা উচিত?’

‘আমাদের কি কেউ ডেকেছিল? তা ছাড়া, স্বাধীন দেশ শুধু মৃত গেরিলার পূজা করে, তোমরা জানো না হে! তবে ক্ষমতার কাছে থাকলে অন্য কথা।’

‘না মানে, আমি আপনার মতো সাধারণের কথা বলছি, দেশের জন্য জীবন বাজি রাখলেন, যুদ্ধের পর সেই দেশ গঠনে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছা করেনি?’

‘না। করেনি। আমরা তো জানপ্রাণ ঢেলে দেশ স্বাধীন করলাম, বাকিটুকু তোমরা করতে পারছ না কেন? দেশ রক্ষার কথায় একদিন জীবন তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, সেখানে প্রতিদিন হাজারো অনাচার দেখতে কেমন লাগে, কখনো ভেবে দেখেছ?’

গাড়ির জোরে ব্রেকের শব্দে তাদের কথা বন্ধ হয়ে যায়। একটা লোক সামনের চাকার পাশ থেকে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। ড্রাইভার জানালা খুলে ধমকায়, ‘ওই মিয়া, এত্ত বড় গাড়িডা দেখবার পাও না?’ লোকটার কনুই আর হাঁটু থেকে রক্ত ঝরে। ড্রাইভার পাশ কেটে যেতে গেলে জামিল চৌধুরী বলেন, ‘আরে করছ কী তোমরা, লোকটা আহত হয়েছে, ওকে আগে একটা ক্লিনিক বা হাসপাতালে নিতে হবে তো।’ লোকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে উল্টো দিকে এগোতে চেষ্টা করে। তরুণেরা বলে, ‘বাদ দেন, আঙ্কেল। ঢাকার জ্যাম তো জানেন, এসব করতে গেলে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাবে।’ ড্রাইভারকে থামতে বলে তিনি দরজা খুলে নেমে পড়েন, বলেন, ‘তোমাদের বক্তার অভাব হবে না। দেশে মুক্তিযোদ্ধার অভাব নেই। কিন্তু কারও বিপদ দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়ার পাগলামি আমার একাত্তরেও ছিল, এখনো আছে। এই পাগলামির জন্যই তোমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক।’