উঠে দাঁড়িয়ে মনে হলো যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি দেখছি

২০০৪ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো গ্রেনেড হামলা ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কজনক অধ্যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই হত্যাচেষ্টার মামলা নিয়ে গড়িমসি চলে। তৎকালীন সরকার নানা উপায়ে তদন্তও বিপথে নেয়। প্রতিষ্ঠার পর ২৫ বছর ধরে প্রথম আলো অনবরত অনুসন্ধান করে চলেছে সমসাময়িক ইতিহাসের চাপা দেওয়া ঘটনার পেছনের সত্য। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা তার অন্যতম। প্রথম আলোর মহাফেজখানা থেকে সে অনুসন্ধানের কিছু নির্বাচিত অংশ পাঠকদের জন্য পেশ করা হলো।

বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পর ঘটনাস্থলে পড়ে আছে কয়েকজনের রক্তাক্ত দেহ, ২১ আগস্ট ২০০৪
ছবি: জিয়া ইসলাম

২১ আগস্ট, ২০০৪ সাল বিকেলে। ‘ধুপ’ করে ছোট একটা শব্দ হলো ট্রাকের ডান কোনায়। এই ট্রাকটিই ভ্রাম্যমাণ মঞ্চ। সবে ভাষণ শেষ করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা।

বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী এই সমাবেশ শেষে মিছিল হওয়ার কথা ছিল। সে কারণেই সেদিন সড়কের ওপর মঞ্চ না করে ট্রাকে ভ্রাম্যমাণ মঞ্চ করা হয়েছিল। আমার চেষ্টা ছিল একই ফ্রেমে শেখ হাসিনাসহ জনসভায় উপস্থিত লোকের একটি ভালো ছবি তোলা। তাই আমিও ট্রাকের মঞ্চে উঠে পড়ি। নেত্রী ভাষণ শেষে নামবেন। এমন সময় ট্রাকের পেছন থেকে ওই শব্দটি কানে এল।

অনেক বছর ধরে হরতাল, সংঘর্ষ, ভাঙচুর, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া আর পিকেটিংয়ের অ্যাসাইনমেন্ট করতে করতে কোনটা বোমার শব্দ, কোনটা টিয়ার গ্যাসের শেল বা গুলির আওয়াজ এগুলো চিনে ফেলেছি। কাজেই শব্দটি শুনেই বুঝতে অসুবিধা হয়নি ঘটনা কী ঘটেছে।

এর মধ্যেই কয়েক ফুটের ব্যবধানে একই রকম আরেকটা বোমা ফাটার শব্দ। প্রথমটির কয়েক সেকেন্ড পর। তারপর আবার...। এরপর একই সঙ্গে অনেক ঘটনা ঘটতে শুরু করল। ট্রাকের চারপাশে গিজগিজ করছিল মানুষ। বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই যে যার মতো ছিটকে দূরে সরে যাচ্ছিল।

কয়েকজন রাস্তার মধ্যে শুয়েও পড়েছে। ট্রাকের পাশে কুণ্ডলী পাকানো ধূসর ধোঁয়া। মানুষের চিৎকার, হুটোপুটি, কান্নার আওয়াজ—যেন নরক ভেঙে পড়েছে। ছুটতে থাকা কোনো একজনের ধাক্কায় পড়ে যেতে যেতে চোখে পড়ল একটু দূরে শেখ হাসিনাকে নেতা-কর্মীরা মানববর্মের মতো ঘিরে রেখেছেন।

চট করে উঠতেও পারছিলাম না। ট্রাকে যে ফটোসাংবাদিকেরা ছিলেন তাঁদের কয়েকজন ভারসাম্য হারিয়ে এসে পড়েছেন আমার ওপর। একই সঙ্গে বাড়ছিল মানুষের চিৎকার আর কান্না। তখনই শুরু হলো টানা গুলির শব্দ। আমার ওপরে যাঁরা পড়েছিলেন, তাঁদের চাপে এমনিতেই দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার দশা, গুলির শব্দে তাঁরা জীবন বাজি রেখে নিচের দিকে আরও চাপতে লাগলেন।

এর মধ্যেই দেখি একজন ফটোসাংবাদিক এক হাতে তাঁর ক্যামেরাটা উঁচু করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ক্লিক করে যাচ্ছেন। ঘোরতর জীবন সংশয়ের মধ্যে আমারও কর্তব্যবোধ জেগে উঠল। ক্যামেরা উঁচু করে শাটার বাটনটা চেপে এদিক-ওদিক ঘোরাতে লাগলাম। ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি উঠতে লাগল পটাপট।

এভাবে কতক্ষণ ছিলাম, জানি না। পরে শুনেছি, খুব বেশি হলে টানা দুই-আড়াই মিনিট। তবে আমার মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল।

একসময় গুলি-বোমা থামল। তারও খানিক পরে আমরা ফটোসাংবাদিকেরা উঠে দাঁড়ালাম। আমরা কয়েকজন অক্ষত আছি। কিন্তু চারপাশে তাকিয়ে যা নজরে এল তা অবর্ণনীয়, বীভৎস। লোকজনের শরীর থেকে অবিরাম রক্ত ঝরছে, চেনা যাচ্ছে না কাউকে।

উঠে দাঁড়িয়ে ট্রাকের চারপাশে তাকিয়ে মনে হলো বিদেশি কোনো যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি দেখছি বুঝি। একটু আগেই ছিল কী সুন্দর পরিবেশ। লোকে লোকারণ্য। এখন সেখানে বহু মানুষ শুয়ে কাতরাচ্ছেন। সবাই রক্তাক্ত। রক্তে লাল হয়ে আছে পুরো রাস্তা।

এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আহত মানুষদের মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ বের হচ্ছে। জোরে চিৎকারও করতে পারছেন না তাঁরা। কী করব, সেই চেতনাও নেই। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের এই মাথা থেকে ওই মাথায় আহত ব্যক্তিদের গা বাঁচিয়ে শুধু মনে হয় দৌড়াদৌড়ি করছি। গলা শুকিয়ে আসছে। এত রক্ত! এত রক্ত!

এভাবে কতক্ষণ পেরিয়েছে বলতে পারব না। কয়েকজন মানুষ আমাকে সাংবাদিক হিসেবে চিনতে পেরে ছুটে এসে চিৎকার করে বলছিলেন, ‘এই যে ভাই, ওইখানে একটা আস্ত গ্রেনেড পড়ে আছে। ওটার ছবি তোলেন তাড়াতাড়ি...।’ ক্যামেরা চোখে নিলাম। ক্লিক করে যাচ্ছি। চারপাশে এত নিহত-আহত মানুষ, কাকে রেখে কার ছবি তুলব!

ট্রাকের বাঁ পাশে দেখতে পেলাম আইভি রহমান বিমূঢ় হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর দুই পা-ই মনে হচ্ছে উড়ে গেছে। তাঁর চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছেন আরও কয়েকজন নারী।

আহত না নিহত বোঝার উপায় নেই। ট্রাকের ডান দিকে সাদা শার্ট গায়ে এক বিশালদেহী মানুষ উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। নিথর দেহ। পড়ে থাকার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে প্রাণ নেই। এক বুড়ো মানুষ পড়ে আছেন, তাঁর পাশে অল্পবয়সী আরেকজন। রক্তের মধ্যে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। অনেক রক্তাক্ত মানুষ আর্তনাদ করছেন সাহায্যের জন্য।

মানুষের আর্তনাদে কি বাতাস ভারী হয়ে ওঠে? শ্বাস নিতে কষ্ট হতে থাকে? ট্রাকের তেলের ট্যাংক ফুটো হয়ে গেছে, সেই ফুটো দিয়ে বড় বড় ফোঁটায় তেল পড়ছে। আগুন কেন লাগেনি, সেটাই আশ্চর্য। কালো ডিজেলের স্রোত এগিয়ে চলেছে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে ড্রেনের দিকে। সেখানে আরেকটা তরল স্রোতও এসে মিশেছে। সেই স্রোতের রং লাল আর কালো। সব মিলিয়ে বীভৎস দৃশ্য।

জিয়া ইসলাম: ফটোসাংবাদিক হিসেবে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী

প্রথম আলো, ২১ আগস্ট ২০১৬